কৃষি | ই-কৃষক | Page 3

Category Archives: কৃষি

আম ও কাঁঠালের মুকুলঝরা সমস্যা ও সমাধান

গরীবের আমিষ ও জাতীয় ফল কাঁঠালের মুকুলঝরা সমস্যাটি বড় সমস্যা। এর কারণে কাঁঠাল ঝরে পড়ায় ফলন মারাতক কমে। মুকুল আসার সময় একটু সচেতন হলেই মুকুল ঝরা কমানো যায়।

পুষ্টিহীনতাঃ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদের ১৭টি পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। এর যেকোনো একটির অভাব কিংবা পরিমান বেশী হলে কাঁঠালগাছ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। কাঁঠাল গাছের পুষ্টি নিশ্চত করতে বর্ষার আগে একবার, বর্ষার পরে একবার এবং মুকুল আসার সময় আরেকবার সার দিতে হয়। এজন্য ঠিক দুপুরে গাছের ছায়া যতটুকু স্থান দখল করে ততটুকু স্থান কুপিয়ে সার ছিটিয়ে সেচ দিতে হয়। এছাড়া সেচ দিতে হয় নিয়মিত।

সারঃ
বর্ষার আগে ও পরে প্রতিবারে ষোল বছরের বেশী বয়সের কাঁঠাল গাছের জন্য নব্বই থেকে ১০০ কেজি গোবর, দেড় থেকে দুই কেজি ইউরিয়া, এক থেকে দেড় কেজি করে টিএসপি ও এমপি সার দিতে হয়। মুকুল আসার সময় যেকোনো বয়সের গাছের জন্য ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সার দিতে হয়। এতে মুকুলঝরা কমে যায়।

সেচঃ
প্রত্যেকবার সার ছিটানোর পর সেচ দিতে হয়। শুস্ক মৌসুমে প্রতিদিন নিয়মিত সেচ দিলে গাছের মুকুলঝরা কমে, কাঁঠালের বোঁটা শক্ত হয়, ফল রসালো হয়, রোগবালাইও হয় কম। ফলন হয় বেশি।
প্রতিদিন সেচ দেওয়ার জন্য কাঁঠাল গাছের গোড়ার চারপাশে মাটি দিয়ে আইল তৈরি করে গোলাকার আইলের মধ্যে পানি ঢেলে সেচ দিতে হয়।

কাঁঠালের পোকামাকড়ঃ
কাঠাঁল গাছের বাকলের মাজরা পোকা ও মুকুলের মাজরা পোকা প্রধান। মুকুলের মাজরা পোকা কচি কাগু, ফুলের কুড়ি ও বেড়ে ওঠা ফলের গায়ে গর্ত করে ভেতরে ঢুকে,সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। এতে আক্রান্ত কান্ড দুর্বল হয়ে পড়ে ও কুঁিড়গুলো শুকিয়ে মরে যেতে থাকে।
বাকলের মাজরা পোকা রাতে গাছের বাকল বা ছাল খায়। খাওয়া অংশ নরম আশেঁর মতো দেখায়।। আশেঁর ভেতর দিয়ে পোকাগুলো কাগেু ছোট ছোট সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভেতরে ঢুকে। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। কাঁঠালের উৎপাদনও কম হয়।

পোকামাকড় দমনঃ
মুকুলের মাজরা পোকা দমনের জন্য ১০ লিটার পানিতে ৩০ মিলি এবং বাকলের মাজরা পোকার জন্য ৩৫ মিলি ডায়াজিনন-৬০ ইসি মিশিয়ে ২১ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।

কাঁঠালের রোগঃ
ছত্রাকের কারণে কাঁঠালের মুকুল পচাঁ রোগটিই মুকুল ঝরার প্রধান সমস্যা। আক্রান্ত মুকুল প্রথম দিকে ধূসর দেখায়, পরে মুকুলের গায়ে সরু ও লম্বা সাদা ছত্রাক দেখা যায। আক্রান্ত মুকুল শেষে মাটিতে ঝরে পড়ে।
গাছে মুকুল আসার পর মুকুল পচাঁ রোগ দেখার সাথে সাথে ডায়থেন এম-৪৫ ওষুধটির চার গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

হরমোন প্রয়োগঃ
নিয়মিত সেচ, মুকুল আসার পর সার দেওয়া, রোগ ও পোকামাকড় দমনে ওষুধ প্রয়োগের পরও যদি মুকুল ঝরে পড়ে তাহলে গাছে ষ্টিমুলেট নামের হরমোন দিতে হবে। এতে স্ত্রী মুকুল বেশি টিকে থাকায় মুকুল ঝরে পড়ে না। কাঁঠালের মুকুলঝরা রোধের জন্য ষ্টিমুলেট হরমোনটি প্রতি লিটার পানিতে তিন মিলি মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করে দিতে হবে দুই থেকে তিনবার।

আমের মুকুল ঝরা রোধে করণীয়
সাধারণত মাঘ-ফাল্গুনে আম গাছে মুকুল-ফুল-গুটি আসে। আমের এ অবস্থায় ছত্রাকজনিত নানা রোগের আক্রমণে উত্পাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে। এসব ছত্রাকজনিত রোগের একটির নাম শুকনা ক্ষত বা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ। মুকুল বা ফুল এ রোগে আক্রান্ত হলে তা কালো হয়ে ঝরে পড়ে। গুটি বা ছোট অবস্থায় আক্রান্ত হলে আমের গায়ে ধূসর বাদামি বা কালো দাগ পড়ে। বেশি আক্রান্ত হলে এগুলোও ঝরে পড়ে। আমের মুকুলে এ রোগের আক্রমণ হলে গাছের সব মুকুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই এ সময় ছত্রাকনাশক স্প্রে করে রোগ দমন করতে হয়। এক্ষেত্রে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি লিটার হারে সিমবুশ ও ০.৫ মিলি লিটার হারে টিল্ট ২৫০ ইসি মিশিয়ে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আবার আম গুটি বা মটর দানার আকৃতি ধারণ করলে একই মাত্রায় এ বালাই নাশক দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে।

পাউডারি মিলডিউ নামক এক প্রকার ছত্রাকজনিত রোগেও আমের মুকুল-ফুল-গুটি আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত অংশে পাউডারের গুঁড়ার মতো এক প্রকার জিনিস দেখা যায়। রোগের ব্যাপক অবস্থায় আক্রান্ত অংশ সাদা পাউডারে ঢেকে যায় এবং ঝরে পড়ে। এ রোগ প্রতিরোধেও গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে থিওভিট ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে একইভাবে স্প্রে করতে হয়। আবার গুটি হলে একই মাত্রায় একইভাবে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে।

আমের মুকুলের ক্ষতিকারক পোকার মধ্যে মিলিবাগ বা হপার একটি মারাত্মক পোকা। হপার দেখতে সবুজ-বাদামি রঙের হয়ে থাকে। নিমম্ফ ও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় এরা ক্ষতি করে। এ পোকার আক্রমণে ২০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত আমের উত্পাদন কমে যেতে পারে। আম গাছে মুকুল আসার সময় প্রতিটি মুকুলে অসংখ্য হপার নিমম্ফ দেখা যেতে পারে। এরা মুকুলের রস চুষে খায়। এতে মুকুল বিবর্ণ হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে। এ পোকা যখন মুকুলের রস চুষতে থাকে তখন এদের মলদ্বার দিয়ে প্রচুর আঠালো রস নিঃসরণ হয়। এ রস মুকুলের ফুল ও পাতায় আটকে যায়। এতে শুটি মোল্ড নামক এক প্রকার ছত্রাক জন্মে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে পাতার উপরিভাগ ছেয়ে ফেলে। ফলে পাতা কালো দেখায়।
সবুজ পাতা কালো আস্তরণে ঢাকা থাকে বিধায় সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উত্পাদন ব্যাহত হয়। ফলে গাছ দুর্বল হয় এবং ফলন কমে যায়। মারাত্মক এ হপার পোকা দমনে আমের বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আগাছামুক্ত ও খোলামেলা অবস্থায় রাখতে হবে। এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ১.০ মিলি হারে বাসাথ্রিন বা রিপকর্ড বা সিমবুশ ১০ ইসি মিশিয়ে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। আবার গুটি অবস্থায় ওই ওষুধ আরও একবার স্প্রে করতে হবে। এ পোকার সৃষ্ট ছত্রাক দমনের জন্যও মুকুল আসার পর এবং ফুল ফোটার আগে থিওভিট ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে একইভাবে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া আমের গুটি অবস্থায় পুনরায় স্প্রে করতে হবে।

আম পূর্ণাঙ্গ ফলে রূপ নেয় কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। প্রথমে মুকুল, মুকুল থেকে ফুল, ফুল থেকে গুটি এবং গুটি বড় হয়ে আম ফলে রূপ নেয়। প্রতিটি পর্যায়েই আম গাছের বালাই ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবে মুকুল আসার আগে এবং পরে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কেননা, মুকুল ঝরে পড়েই আমের উত্পাদন বহুলাংশে হ্রাস পায়।

সূত্র: Modern Agriculture Facebook page

মৌমাছি পালন ও মধু চাষ

অধিকারী চ. মিঠু's photo.

আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদেরকে সামাজিক পতঙ্গ বলা হয়। মৌমাছি থেকে আমরা মধু ও মোম পাই। মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে লালন-পালন বা চাষ করা যায়। এবং অধিকতর লাভবান হওয়া যায়।

মৌমাছির প্রজাতি
আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়, যথা:
1. পাহাড়ী মৌমাছি,
2. ভারতীয় মৌমাছি ও
3. ক্ষুদে মৌমাছি।

পাহাড়ী মৌমাছি
এরা আকারে সবচেয়ে বড়। বড় বড় গাছের ডালে, পাহাড়ের গায়ে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ১০ কেজি। এরা পোষ মানে না তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় না।

ভারতীয় মৌমাছি
এরা আকারে মাঝারি ধরনের। অন্ধকার বা আড়াল করা স্থান গাছের ফোকর, দেওয়ালের ফাটল,আলমারি, ইটের স্তুপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। এরা শান্ত প্রকৃতির। তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায়।

ক্ষুদে মৌমাছি
এরা আকারে সবচেয়ে ছোট। এরা ঝোপ জাতীয় গাছের ডালে, পাতায় ও শুকনো কাঠি প্রভৃতিতে চাক বাঁধে। চাকার আকার খুব ছোট। বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম । এরা শান্ত প্রকৃতির। তবে এক স্থানে বেশিদিন থাকে না।

মধু ও মোম
মধু একান্তভাবে মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নেয় এবং তা জমা করে পাকস্থলীর উপরে এক বিশেষ অঙ্গে যাকে মধুথলি বলে। ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় এর সঙ্গে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়। এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়, যা চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে। তরুণ শ্রমিক মৌমাছিরা এ সময় ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে এবং তাদের লালার সংগে মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা জমা করে খোপে। শ্রমিক মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়। ফলে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু, যা জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়। শ্রমিক মৌমাছির পেটের তলায় পকেটের মত ভাজ থাকে মোমগ্রন্থি। সেখানে তৈরী হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতের মত মোম কণা। এ মোম দিয়ে শ্রমিকেরা বানায় বাসা।

মৌমাছি সংগ্রহ ও কৃত্রিম খাবার
প্রকৃত থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী ও কিছু শ্রমিক) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌচাষ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেবার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লে ও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

মধু সংগ্রহ
মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এ মধুতে মৌমাছির দেহাংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে। এছাড়া এ ধরনের মধু অশ্প দিনের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্য মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবার ব্যবহার করা যায়।

মৌমাছি পালনের উপকারী দিকসমূহ
দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্ঠিহীনতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য। যা বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে।

মধু রোগ (যথা: সর্দি, কাশি, বাত, ব্যাথা ইত্যাদি) জীবানুনাশক হিসাবে ব্যবহার করে।

মোম, মোমবাতি, প্রসাধন (কোল্ড ক্রীম, সেভিং ক্রীম, স্নো ইত্যাদি) ঔষধ বিভিন্ন মলম তৈরী ব্যবহার হযে থাকে।

মধু ও মোম বিক্রয় করে বাড়তি আয়ের সংস্থানের মাধমে পারিবারিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করে যা সার্বিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য দূরীকরনের সাহায্য করে।

ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও জীব বৈচিত্রে সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মৌমাছি পালনের আয়-ব্যয়
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌমাছি পালন করলে এবং এলাকায় পর্যাপ্ত সহায়ক গাছ-পালা থাকলে একটি বাক্স থেকে মধূ (শীতকালে) ৭/৮ কেজি এবং বছরে ১৮/২০ কেজি খাটি মধু সংগ্রহ করা যায়।

আয় :
উৎপাদিত মধু = ১৫ কজি
কেজি প্রতি টাকা ৩০০.০০ হিসেবে
মোট (১৫x৩০০.০০) = ৪,৫০০.০০ টাকা

ব্যয়:
মৌমাছির বাক্সের দাম = টাকা ৭০০.০০
মৌমাছির দাম = টাকা ৭০০.০০
কৃত্রিম খাদ্য = টাকা ৫০.০০
অন্যান্য = টাকা ৫০.০০
মোট = টাকা ১,৫০.০০

লাভ:
= আয়-ব্যয়
= টাকা ৪,৫০০.০০
= টাকা ৩,০০০.০০

সূত্র: modern agriculture ফেইজবুক পেইজ

উন্নত পদ্ধতিতে লিচু চাষ

বাংলাদেশে লিচু একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর ফল। যদিও এ দেশে এটি অতি সহজেই জন্মানো যায়, তথাপি এখানে এর চাষ তেমন ব্যাপকতা লাভ করেনি। এ দেশের সব জেলাতেই লিচুর চাষ করা যায় কিন্তু বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়। রূপে, গুণে ও স্বাদে এটি একটি উপাদেয় ফল বিধায় অনেকে বিশ্বের সবচেয়ে লোভনীয় ও সুস্বাদু ফল বলে মনে করেন। এতে ঔষধি গুণ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, শর্করা জাতীয় পদার্থ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। বাজারে অল্প সময়ের জন্য থাকলেও সবার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফল হিসেবে পরিচিত। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে এ ফল চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।

জলবায়ু :
লিচু একটি অবউষ্ণ জলবায়ুর ফল। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে গাছ ভালোভাবে বাড়লেও ফুল ধারণের জন্য মৃদু ঠাণ্ডার আবেশ দরকার। অউষ্ণমণ্ডলের যেখানে শীতকালে ঠাণ্ডা অথচ তুষারপাত হয় না এবং গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজমান সেখানে লিচু ভালো হয়। শীতকালে তুষারপাত ও গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া লিচু চাষের প্রধান অন্তরায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০ সেমি. ও বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০-৮৫% লিচু চাষের জন্য উপযোগী। গাছে ফুল আসার সময় বৃষ্টিপাত হলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। গ্রীষ্মকালে পর্যায়ক্রমে শুষ্ক আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। পাকার সময় আবহাওয়া শুষ্ক হলেও ফল ফেটে যায়।

মাটি :
সব মাটিতে লিচু ভালো হয়। তবে প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ নিষ্কাশিত গভীর উর্বর দো-আঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য সর্বোত্তম। যদিও জলাবদ্ধতা এর জন্য ৰতিকর কিন্তু লিচু স্যাঁতসেঁতে মাটি পছন্দ করে। অমৱ ও ৰার উভয় প্রকার মাটিতেই লিচু চাষ করা চলে কিন্তু অমৱমাটি অধিক উপযোগী। কেননা এ ধরনের মাটিতে জন্মানো গাছের শিকড়ে মাইক্রোরাইজা উৎপন্ন হয়। এ ছত্রাকগুলো মিথোজীবীতার মাধ্যমে গাছে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে। সাধারণত মাটির পিএইচমান ৬.৫-৬.৮ হলে লিচু চাষ উপযোগী হয়। তবে বেলেমাটি লিচু চাষের অনুপযুক্ত। নতুন চারার গোড়ায় পুরনো লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করে দ্রুত মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয়।

জমি তৈরি :
লিচু চাষের জন্য নির্বাচিত জমি ভালো করে লাঙল, পাওয়ারটিলার, কিংবা ট্রাক্টর যে কোনোটির দ্বারা চাষ ও পরে মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে। জমি থেকে ইট, পাথর, অন্য কোনো গাছের গোড়া ইত্যাদি যদি থাকে তবে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। জমি চাষের ফলে মাটিতে প্রচুর বায়ু চলাচল হয়। ফলে মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি গাছের জন্য সহজলভ্য হয়। তাছাড়া শিকড় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

রোপণ প্রণালী :
রোপণ প্রণালী হলো রোপিত চারার পারস্পরিক অবস্থান। প্রতি হেক্টর জমিতে কি পরিমাণ লিচুর চারা লাগানো সম্ভব তা নির্ভর করে রোপণ দূরত্ব, জমির আকৃতি ও রোপণ প্রণালীর ওপর। সমতল ভূমিতে বর্গাকার প্রণালীতে এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর প্রণালীতে লিচু গাছের চারা লাগানো হয়।

বাগানের নকশা :
লিচু বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনাটিকে যখন বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কাগজে অঙ্কন করা হয় তখন তাকে বাগানের নকশা বলা হয়। নকশা অনুযায়ী গাছের চারা লাগালে প্রত্যেকটি চারা অপরটির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও স্বাভাবিকভাবে ফল ধারণ করে। তাছাড়া বাগান রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম পড়ে এবং সেচ ব্যবস্থা সুন্দর হয়। কম জায়গায় সর্বোচ্চসংখ্যক চারা লাগানো যায়। বাগানের ভেতরে সাথী ফসলেরও চাষ করা সহজ হয়।

জাত নির্বাচন :
বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে চাষকৃত লিচু জাতের মধ্যে বেদানা, বোম্বাই, চায়না-৩, রাজশাহী, মাদ্রাজি, মংগলবাড়ী, মোজাফফরপুরী, বারি লিচু-১ ও ৩ উল্লেখযোগ্য। লিচুর কলম রোপণ
গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে লিচু একটি জনপ্রিয় ফল। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় লিচু সব জায়গায় ভালো ফলন দেয় না। বিশেষ কিছু জাত বিশেষ জায়গায় বেশ ভালো ফলন দেয় এবং সেসব জায়গা সেই লিচুর জাতের নামেই পরিচিতি পেয়ে গেছে। যেমন- রাজশাহীর লিচু (জাত : মুম্বাই), পাবনার ঈশ্বরদীর লিচু (জাত : মুম্বাই, মাদ্রাজি), দিনাজপুর (জাত : বেদানা ও কাঁঠালি)। এ ছাড়া চায়না-৩ জাতের লিচু দেশের প্রায় সব জেলাতেই চাষ হচ্ছে।

চারা নির্বাচন :
লিচুর বংশবিস্তার করা হয় প্রধানত গুটি কলম করে। লিচু ফলের মওসুম শেষেই শুরু হয়ে যায় ফলগাছ রোপণ মওসুম। অন্যান্য ফলগাছের মতো লিচুর কলম কিন’ বর্ষার শুরুতেই রোপণ করা ঠিক নয়। এ জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়।
বর্ষার পর যখন মাটিতে রসের আধিক্য কমতে থাকে তখনই লিচুর কলম রোপণ করতে হয়। আসলে লিচুর গুটি কলম অন্যান্য ফলগাছের গুটি কলমের মতো নয় বলেই মাটিতে বেশি রস থাকলে রোপণ করা উচিত নয়। তবে যেসব জায়গা উঁচু, মাটি বেলে দো-আঁশ ধরনের, যে মাটিতে পানি দীর্ঘক্ষণ জমে থাকে না এবং সারা দিন রোদ পড়ে সেসব জায়গাই লিচুর কলম রোপণের জন্য উপযুক্ত। লিচুর বংশ বিস্তার দু’ভাবে করা যায়। সরাসরি বীজ থেকে এবং কলমের মাধ্যমে। বীজ থেকে চারা তৈরি করলে ফল ধরতে ৮-১০ বছর লেগে যায়। তাছাড়া জাতের গুণাগুণ লোপ পায়। লিচুর জন্য গুটি কলম বেশি উপযোগী। এতে মাতৃ গুণাগুণ বজায় থাকে। কাজেই এক বছর বয়স্ক সুস্থ ও সবল গুটি কলমের চারা বাছাই করে লাগাতে হবে।

চারা রোপণের দূরত্ব :
ঘন করে লিচুর চারা লাগানো হলে সেসব গাছে সূর্যের আলো পায় না। ফলে গাছে খাদ্য প্রস্তুত ভালোভাবে হয় না। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া রোগ-পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গাছের জন্য অনুমোদিত দূরত্ব অনুরসণ করলে উপরিউক্ত সমস্যা থাকে না। লিচুগাছ সাধারণত ১০-১২ মিটার (অর্থাৎ ৩০-৪০ ফুট) দূরত্বে লাগানো হয়।

চারা রোপণের সময় :
বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় অর্থাৎ জুন-জুলাই মাস। তবে চারা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লাগানো চলে। প্রখর রোদ ও হাওয়ায় চারা লাগানো যাবে না। বিকেলে চারা লাগানো উত্তম।

গর্ত তৈরি :
বর্ষার আগেই নির্ধারিত জায়গায় গর্ত করতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য ১ মিটার, প্রস্থ ১ মিটার ও গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে। গর্ত তৈরির সময় গর্তের ওপরের মাটি এক পাশে ও নিচের অংশের মাটি অন্য এক পাশে রেখে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ফলে মাটিতে কীট বা রোগের জীবাণু থাকলে রোদে তা মারা যাবে। গর্তের ওপরের অংশের মাটির সাথে ২০-২৫ কেজি গোবর সার, কিছুটা পুরনো লিচু বাগানের মাটি, টিএসপি ৬০০-৭০০ গ্রাম, এমপি ৩৫০-৪৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ -৩০০ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট ৪০-৬০ গ্রাম মিশিয়ে দিতে হবে এবং ওপরের এই সার মিশ্রিত মাটি গর্তের নিচে এবং গর্তের নিজের মাটি গর্তের ওপরে দিয়ে পুরো গর্তটি ভরাট করতে হবে। প্রতি বছর সারের পরিমাণ কছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে। গাছের বয়স ১০-১৫ বছর হলে সারের মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে।

চারা রোপণ পদ্ধতি :
গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর চারাটি ঠিক গর্তের মাঝখানে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর খুঁটি এবং প্রয়োজনে খাঁচা দিয়ে চারাকে রক্ষা করতে হবে। চারা লাগানোর পর পরই চারার গোড়ায় পানিসেচ দিতে হবে।

সারের পরিমাণ :
এক থেকে তিন বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ১০-২০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ১৫০-২০০ গ্রাম।

চার-ছয় বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ২০-৩০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম।

৭-১০ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৩০-৪৫ কেজি, ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম, টিএসপি৭০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম।

১০ বছরের বেশি বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৫০-৬০ কেজি, ইউরিয়া ১০০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম।

গাছে যদি জিঙ্কের অভাব দেখা দেয় অর্থাৎ পাতা যদি তামাটে রঙ ধারণ করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার পানির সাথে ২ কেজি চুন ও ৪ কেজি জিঙ্ক সালফেট গুলে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। ফল ঝরা কমাতে এটা সাহায্য করবে। ফল ফেটে যাওয়া কমাতে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম বোরিক পাউডার গুলে ফলে স্প্রে করা যেতে পারে।

গাছের যত্ন :
সময়মতো মাঝে মধ্যে মরা ডাল পরিষ্কার করা দরকার। সাধারণত লিচুতে অঙ্গছাঁটাই প্রয়োজন নেই তবে গাছের আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ছাঁটাই করা যেতে পারে। লিচুতে প্রশাখার অগ্রভাগসহ ফল সংগ্রহ করা হয়, এ পরোক্ষ ছাঁটাই গাছের জন্য উপকারী বলেই মনে হয়।

সেচ প্রয়োগ :
গাছের প্রধানত শীত ও গ্রীষ্মের দিনগুলোতে পানির প্রয়োজন হয় বেশি। চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হয় তবে ফলন্ত গাছের বেলায় পূর্ণ ফুল ফোটা অবস্থায় একবার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে আর একবার সেচ দিতে হবে। ফল আসার পর সেচ না দিলে ফল পড়ে যায় ও ফল ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শীতকালে বিকেলের দিকে সেচ দিলে ঠাণ্ডায় গাছের ৰতি হয় না। গাছের গোড়ায় বেশি বা কম রস গাছের বৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর। তাই পরিমাণ মতো পানি সেচের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

রোগ :
লিচুর তেমন কোনো মারাত্মক রোগ দেখা য়ায় না। তবে আর্দ্র ও কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় পুষ্পমঞ্জুরি পাউডারি মিলডিউ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া অনেক সময় ছত্রাকজনিত রোগের কারণে ফল পচে যায়। প্রতিকার হিসেবে বর্দো মিশ্রণ ও ডাইথেন এম-৪৫ ছিটানো যেতে পারে।

লিচুর মাইট বা মাকড় :
মাকড়সা জাতীয় এ পোকা আকারে খুবই ছোট এবং এরা পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতায় মখমলের মতো লালচে বাদামি দাগ সৃষ্টি হয়। ফলে গাছ বাড়ে না ও ফলন কম হয়। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত ডালপালা বা ডগা ছাঁটাই এবং ধ্বংস করতে হবে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে সেপ্র করতে হবে। তা ছাড়া মাইট যাতে গাছে উঠতে না পারে সে জন্য কাণ্ডের বা গোড়ার চারপাশে আলকাতরা লাগানো যেতে পারে।

লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা :
ফল পাকার সময় পোকা ফলের বোঁটার কাছে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। ফল পাকার সময় বৃষ্টি হলে এ পোকা বেশি দেখা যায়। এরা ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় ও ফলের বাজার মূল্য কমে যায়। ফলের গুটি ধরার পর ১৫ দিন পর পর দু’বার সিমবুশ ১ মিলি হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে সেপ্র করতে হবে। রোগ ছাড়াও লিচুর আর একটি আপদ হলো বাদুড়। রাতে ও দিনে টিন পিটিয়ে যথাক্রমে বাদুড়ের এবং পাখি (যেমন কাক ও অন্যান্য পাখি ইত্যাদির উপদ্রব কমানো যায়। তা ছাড়া জাল দিয়েও লিচু রক্ষা করা যায়।

ফল সংগ্রহ :
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লিচু গাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় ফলের খোসা লালচে রঙ ধারণ করে ও কাঁটাগুলো চ্যাপটা হয়ে খোসা প্রায় মসৃণ হয়ে যায়। কিছু পাতাসহ গোছা ধরে লিচু সংগ্রহ করা হয়, এতে ফল বেশি দিন ধরে ঘরে রাখা যায়। বৃষ্টি হলে তার পর পরই কখনো লিচু সংগ্রহ করা ঠিক নয়।

ফলন :
লিচু পুষ্ট হলে ফলের কাঁটা ছাড়বে ও রঙ উজ্জ্বল হবে। পুষ্ট ফল শাখা ও পাতাসহ পাড়া হয়। ২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত লিচুগাছে ফলন বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়। অবস্থাভেদে এর তারতম্যও লক্ষ করা যায়।

অধিকারী চ. মিঠু's photo.
সূত্র: modern agriculture ফেইসবুক পেইজ

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি এবং নিরাপদ ফল উৎপাদন

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। যে সময়ে আমরা চিন্তিত ও আতঙ্কিত ফল বাগানে বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে ঠিক এ সময়েই সন্ধান পাওয়া গেল নতুন এ প্রযুক্তির, যা পরিবেশবান্ধবও বটে।
ফ্রুট ব্যাগিং বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ ধরনের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায় এবং এর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকে ব্যাগটি। এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং ও আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের এবং সবুজ আমের জন্য দুই আস্তরের বাদামি ব্যাগ। আমাদের দেশে যেসব ফলগুলো সহজেই ব্যাগিংয়ে আওতায় এনে সুফল পাওয়া সম্ভব সেগুলো হলো আম, পেয়ারা, ডালিম, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফল নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।

ফ্রুট ব্যাগিং কেন প্রয়োজন:
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ফলে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্রেকজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্প্রে করার প্রকৃত কারণ ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার কারণে ফলচাষিরা এক মৌসুমে ফল বাগানে বহুবার স্প্রে করে থাকেন, যা কোনোভাবেই কাংখিত নয়। আমচাষিরা আম সংগ্রহ করার পর থেকে পরের মৌসুমে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত ১৫-৬২ বার বালাইনাশকের ব্যবহার করে থাকেন। যেখানে গবেষণার ফল থেকে দেখা গেছে ২-৫ বার ক্ষেত্র বিশেষে স্প্রে করলেই ভাল আম সংগ্রহ করা সম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি আমের উৎপাদনকেও ব্যয়বহুল করে তোলে। শুধু তাই নয় অতিরিক্ত স্প্রে করার ফলে উপকারী ও বন্ধু পোকার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এখন মূলত ফলবাগানে স্প্রে করা হয় দেখাদেখি করে। প্রয়োজন থাকুক বা নাই থাকুক সেটি মুখ্য বিষয় নয়। অতীতেও ফল-ফসলে স্প্রে করা হতো, কিন্তু বর্তমানে এর পরিমাণ অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জনজীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জানা-অজানা জটিল রোগে। এ অবস্থায় বিভিন্ন ফলে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বালাইনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। পাওয়া যাবে বিষমুক্ত ফল, কমবে ফলের উৎপাদন খরচ, কমবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা এবং বাড়বে ফলের গুণগতমান। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। আমকে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন হবে না ফরমালিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিকের। এছাড়াও ফলকে বাইরের বিভিন্ন ধরনের আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। যেমন আমের ফল ছিদ্রকারী ও মাছি পোকা আমের বর্ধনশীল পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করা হয় তাহলে কোনো স্প্রে ছাড়াই এ ক্ষতিকর পোকা দুইটির হাত থেকে আম ফলকে রক্ষা করা সম্ভব।

ব্যাগিং কখন করা প্রয়োজন:
গবেষণা করে দেখা গেছে, প্রত্যেক ফলের জন্য ব্যাগিং করার সময় ভিন্ন ধরনের। যেমন আমের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৩৫-৪০ দিন বয়সের আমে। এ সময়ে আম জাতভেদে মটরদানা থেকে মার্বেল আকারের অথবা এর চেয়ে বড় আকারেরও হয়ে থাকে। পেয়ারার ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৫০-৫৫ দিন বয়সে এবং ডালিমের ক্ষেত্রে ২০-২৫ দিন বয়সে। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়। আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।

যেমন,
1. প্রথমবার আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে,

2. দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি. লম্বা হবে তখন এবং

3. আম যখন মটরদানার মতো হবে তখন তৃতীয়বার।

সুতরাং এর পরপরই ব্যাগিং করার পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যাগিং করার আগেই মরা মুকুল বা পুষ্পমঞ্জরির অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

বাংলাদেশে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের সম্ভাবনা:
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন ফল ও সবজিতে ব্যাগিং প্রযুক্তিটি অনেক আগে থেকেই ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিশেষ করে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে সফলতার মুখ দেখেনি। আমের ক্ষেত্রেও ২০০৮ সালে পরীক্ষামূলকভাবে দেশীয় বিভিন্ন প্রকারের ব্যাগ ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু আমের মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ব্যাগ কয়েকবার পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে ব্যাগগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো বৃষ্টিতে নষ্ঠ হয় না। ২০১৪ সালে সেই ধরনের ব্যাগ দিয়ে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিভিন্ন জাতের আমে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত যে কোনো আমের জাতেই ব্যাগটি ব্যবহার উপযোগী।এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙ এর এবং অন্য সব জাতের আমের জন্য বাদামী রংয়ের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে উৎপাদন না হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ ধরনের এই ব্যাগটি চীন থেকে সরাসরি আমদানি করে কৃষকদের মাঝে সরবারহ করছেন। প্রতিটি ব্যাগ ৩/৪টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে। আম ব্যবসায়ীরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন ব্যাগটি চলতি মৌসুমে বাজারজাত করার জন্য। সুতরাং এ ধরনের ব্যাগ বাংলাদেশে পাওয়া গেলে নিঃসন্দেহে ফলচাষিরা উপকৃত হবেন। দেশের মানুষ পেতে পারেন বিষমুক্ত ভালো মানের দেশীয় ফল। তেমনিভাবে পেয়ারা ও ডালিম চাষিরাও ব্যবহার করতে পারবেন এ বিশেষ ধরনের ব্যাগটি।

তথ্যসূত্র:
কৃষিবিদ ড. মো. শরফ উদ্দিন
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

অধিকারী চ. মিঠু's photo.
অধিকারী চ. মিঠু's photo.

রিবন রেটিং/পাটের ছালকরণ/পঁচন পদ্ধতি

রিবন রেটিং/পাটের ছালকরণ/পঁচন পদ্ধতি

পানির অভাবে যেসব এলাকায় উৎপাদিত পাট পঁচানো সমস্যা হয় সেসব এলাকার চাষি ভাইদের জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট রিবন রেটিং/পাটের ছালকরণ/পঁচন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে।

সুবিধাসমূহ:
1. ছাল পঁচানোর জন্য পানি, জায়গা ও সময় কম লাগে,
2. আঁশে কাটিংস হয় না,
3. আঁশের মান ভাল হয়,
4. এ গ্রেডের আঁশ পাওয়া যায়,
5. মূল্য বেশি পাওয়া যায়,
6. পরিবহন খরচ কম লাগে,
7. স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা,
8. পদ্ধতিটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক,
9. পাট খড়ি শক্ত থাকায় জ্বালানি ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহারে টেকসই এবং সুবিধাজনক।

ছালকরণ প্রক্রিয়া
বাঁশের হুকের দীর্ঘস্থায়ী লোহার সিংগেল রিবনার এবং ডাবল রোলার রিবনারের মাধ্যমে ছালকরণ যন্ত্র বা রিবনারের সাহায্যে সহজেই কাঁচা পাট গাছ থেকে ছাল ছাড়ানো যায়।

1. প্রথমে ৬ ফুট লম্বা এক খণ্ড বরাক বাঁশ নিয়ে এর যে কোন এক প্রান্ত আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে যেন বাঁশের প্রান্তটির দুদিক ইংরেজি টি অক্ষরের মতো দেখায়।

2 এবার বাঁশ খণ্ডটির গোড়ার কিছু অংশ প্রায় ১ ফুট মাটির মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দিতে হবে।

3. পাশাপশি ৩ থেকে ৪ ফুট দূরে দূরে প্রয়োজন মতো এমন বেশ কয়েকটি বাঁশের হুক স্থাপন করা যায়।

4. এবার সে বাঁশের হুকগুলোর সাথে একটি মুরুলি বাঁশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে আড়া বাঁধতে হবে যার উপরে পাট গাছ জমি থেকে কেটে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে।

5. ১০০-১ ১০ দিন বয়সের পাট কেটে পাট গাছগুলো বাঁশের আড়ার উপরে দাঁড় করানোর পর হাত দিয়ে পাতা ঝরিয়ে গাছের গোড়ার ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি অংশ একটি শক্ত কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে থেতলে নিতে হবে।

6. প্রতিটি গাছের গোড়ার থেতলানো ছালগুলো হাত দিয়ে দু’ভাগ করে পাট গাছের গোড়া হুকের মধ্যে রাখতে হবে। গোড়ার ছালের দুভাগ পৃথক পৃথকভাবে দু’হাত ধরে একসাথে জোরে টান দিলে দেখা যাবে পাটের ছালগুলো সহজেই খড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেছে এবং পাটখড়ি সামনের দিকে চলে গেছে।

7. এভাবে ৪ থেকে ৫টি পাট গাছের ছাল একসাথে বের করা সম্ভব। একইভাবে সিঙ্গেল রোলার ও ডাবল রোলার রিবনারের সাহায্যেও পাটের রিবনিং করা যায়।

8. বড় মাটির চাড়িতে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চাড়িটি ভরে দিতে হবে। একটি বড় চাড়িতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল পঁচানো যায়।

9. আশেপাশে ছোট ডোবা/পুকুর/খাল/কম গভীরতা সম্পন্ন জলাশয় থাকলে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে একটা লম্বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে পঁচানো যাবে।

10. ১বিঘা জমির পাটের ছাল পচানোর জন্য ১৮ ফুট লম্বা, ৬ ফুট প্রস্থ এবং ৩ ফুট গভীর পরিমাপের গর্ত প্রয়োজন হয়। গর্তে ৮ ০০০-৮৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

11. মোটা পলিথিন দিয়ে গর্তের তলা ও কিনারা ঢেকে দিতে হবে। তারপর গর্তে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে গর্তের ভিতরে মুড়ি বাঁধা ছালগুলিকে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে কঁচুরিপানা দিয়ে ছালের মোড়াগুলো ঢেকে দিতে হবে।

12. ১ কেজি কাচা ছাল পঁচানোর জন্য আড়াই থেকে ৩ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

13. প্রতি ১ মে. টন কাঁচা ছালের জন্য ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার বা ২০ থেকে ৪০ লিটার পাট পঁচন পানি সংগ্রহ করে গর্তের পানির সাথে মিশিয়ে দিলে পানিতে পঁচনকারী জীবাণুর তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি হয়ে পঁচন ত্বরান্বিত হয়।

14. ছাল পানিতে ডুবানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর দু-একটা ছাল পানি থেকে তুলে ভাল করে ধুয়ে দেখতে হবে যদি আঁশগুলো পরস্পর ভালভাবে পৃথক হয়েছে বলে মনে হয তবে আর দেরি না করে পরিষ্কার পানিতে ছাল ধুয়ে আঁশ সংগ্রহ করতে হবে।

15. পরিষ্কার ছালগুলিকে বাঁশের আড়ায় রোদে শুকাতে হবে। আর্দ্রতা যেন ৮ থেকে ১০ ভাগের বেশি না থাকে।

16. প্রতি বিঘা(33 শতক) জমির পাটের ছালকরণে ৪-৬ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

অধিকারী চ. মিঠু's photo.
অধিকারী চ. মিঠু's photo.
Source: Modern Agriculture Facebook page

সজিনা

ইংরেজীতে সজনার নাম ‘‘ড্রামস্ট্রিক’’ যার অর্থ ঢোলের লাঠি। সজিনার ইংরেজী নামটি অদ্ভুত হলেও এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী উদ্ভিদ। বাংলাদেশে এটি নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বিশ্বের বহু দেশে এ নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে বিশেষ করে গাছ বৃদ্ধিকারক হরমোন, ঔষধ, কাগজ তৈরী ইত্যাদি বিষয়ে। বহু দিন হতেই আমাদের দেশে এটি সব্জির পাশাপাশি ঔষধ হিসেবে ব্যাবহার হয়ে আসছে।
দেশের সবত্রই এ সবজিকে আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসত বাড়ির আঙ্গিনায় যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে এ বৃক্ষটি। সজিনার ফুল ও পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয়, পশু খাদ্য হিবেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এর পাতা শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায় এতে শারীরিক শক্তি ও আহারের রুচির উন্নতি হয়। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। ভারতীয়রা এটির স্যুপ খেয়ে থাকে। এ সময়ে ঋতু পরিবর্তনের কারনে আমাদের অনেকেরই মুখে স্বাদ থাকে না। আর এ স্বাদকে ফিরিয়ে আনতে সজিনার জুড়ি নাই। সজিনার গাছটির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ না থাকলে ও এর ডাটার প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। আমরা জানি সবজি মাত্রই পুষ্টিকর খাদ্য। তবে সজিনা শুধু পুষ্টিকর সবজি নয় এটি ওষুধী বৃক্ষও বটে।

জলবায়ুঃ সজিনা চরম পরিবেশ গত অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম তবে ২০ হতে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাল জন্মায় এবং যে সব এলাকায় ২৫০ হতে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ভাল জন্মায়। মাটি বেলে দোঁআশ হতে দোয়াঁশ এবং পিএইচ ৫.০ হতে ৯.০ সম্পন্ন মাটি সহ্য করতে পারে। সজিনাচাষে সারের তেমন প্রয়োজন হয়না। কারন সজনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে। তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভাল হয় ।

বংশ বিস্তারঃ এ বৃক্ষটি বীজ ও ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশে বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষাবাদের রীতি এখন ও পর্যন্ত অনুসরন করা হয় না। কারন বীজ থেকে চারা তৈরি ব্যয়বহুল, কষ্ঠসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, তারপর সে টিকে শুকিয়ে ফাটলে বীজ পাওয়া যাবে। এ বীজ শুকনো বায়ুরোধী পাত্রে ১-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। তার পর জুলাই-আগষ্ট মাসে বীজ তলায় অথবা পলি ব্যাগে বপন করতে পারি। তবে বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে বীজ থেকে চারা গজাতে সুবিধা হয়। বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০থেকে ২০ দিন। চারা বের হবার পর নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ ও অন্যান্য যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল যে, বীজ থেকে সজিনা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডাল পুঁতে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের চেয়ে দেরিতে ফল আসে।

আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তার কারন হল এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। আর খরচ ও কম, অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য ৪-৫// ব্যাসের বা বেডের ৫-৬ হাত লম্বা নিরোগ ডাল এবং আঘাত মুক্ত ডাল ব্যবহার করা ভাল। এটিতে যখন পাতা আসে তখন ছাগল এটিকে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। ডালটি লাগানোর সময় যে বিষয়টি খেয়াল রাখা হবে সেটি হল ডালটি গাছে থাকা অবস্থায় এর আগা বা মাথা এবং গোড়া যে দিকে ছিল পুঁতার সময় যেন ঠিক সেই ভাবেই থাকে। লাগানোর আগে ডালের গোড়ায় একটি ধারালো কিছু দিয়ে তেড়ছা কাট দিতে হবে তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন থেঁতলে না যায়। এ কাজটি করলে ডালটি টিকে যাবার সমাভবনা অনেকগুন বেড়ে যায়। ডালটির গোড়ার প্রায় এক হাত যেন মাটির নিচে থাকে। এবং পুঁতার পর যেন এটি নাড়াচড়া না করে সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ডাল এর মাধ্যমে বংশ বিস্তারের কাজটি আমাদের দেশে করা হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। কারন এ সময় ডাটা সংগ্রহের পর গাছগুলোকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। ফলে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের জন্য এর সহজ প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। তাছাড়া ও এ সময়ে দু‘ একটি বৃষ্টি হয়ে থাকে যার ফলে লাগানো ডালটি সহজেই টিকে যায়।

সেচঃ নতুন লাগানো গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শীঘ্রই শিকড় গজাতে পারে। শুস্ক ও রৌদ্রজ্জ্বল সময় প্রায় দুই মাস সেচ দিতে হবে। তবে সজনার গাছ একবার লেগে গেলে তেমন পানির প্রয়োজন হয় না।

কীট পতঙ্গ ও রোগ নিয়ন্ত্রনঃ সজনার গাছ তুলনামূলক কীট পতঙ্গ ও রোগ সহনশীল ভাবে মাঝে মাঝে পা্রর্দুভাব দেখা যায়। যেমন জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে এর কারন ডিপ্লোডিয়া। কীট পতঙ্গ শুস্ক ও ঠান্ডায় বেশী আক্রমন করে। । কীট পতঙ্গ দ্বারা গাছে হলুদ রোগ দেখা যায়। কীটপতঙ্গের মধ্যে টারমাইটস্, এফিড, সাদা মাছি প্রধান। উপদ্রুপ বেশী হলে রাসায়নিক দমন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

শেষ কথাঃ স্বাদে ও গুনে ভরপুর এ সবজিটির প্রতি আমদের সকলের আগ্রহ থাকলে ও এর চাষাবাদের আমদের অনাগ্রহের কথা অস্বীকার করা যায় না। তাই অন্যান্য সবজির মত এটি আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয় নি। তবে আমাদের দেশে গ্রামের বাড়ি গুলোতে এটির ব্যাপক ভাবে চাষ হয়ে থাকে এবং সজিনা বিহীন বাড়ি না পাওয়ারই কথা। তবে এসবজি চাষে যদি আমরা একটু মনোযোগী হই অর্থাৎ এর বানিজ্যিক উৎপাদন সন্বদ্ধে চিন্তা করি তবে অন্যান্য যে কোন সবজি উৎপাদনের থেকে এটি লাভজনক। কারন অন্যান্য সব্জির মত এর উৎপাদনে তেমন ঝুঁকি নেই এবং লাভজনক।

Source: প্রকৃতি Facebook page

ডাঁটা

১. ফসলঃ ডাঁটা

২. জাতঃ

উচ্চ ফলনশীল জাতঃ উচ্চ ফলনশীল জাত গুলো হলো-

জাত

কোম্পানীর নাম

বপনের সময়

বারি ডাঁটা-১ (লাবনী)

BARI

ফেব্রুয়ারী-জুন

বারি ডাঁটা-২

BARI

ফেব্রুয়ারী-জুন

বাঁশপাতা, আখি, সুফলা-১

ব্র্যাক সীড

কে এস ০১

কৃষিবিদ গ্রুপ সীড

মাঘ থেকে বৈশাখ মাস

ভুটান সফট, রেড ম্যান

গেটকো সীড

অপরাপা, স্বরূপা

নামধারী সীড

লাবনী

এনার্জি প্যাক এগ্রো লি:

বপনের সময় জানুয়ারী-জুন

৩. উপযোগী জমি ও মাটিঃ  প্রায় সব ধরণের মাটিতেই ডাটা চাষ করা হয়। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।

৪. বীজঃ

ভালো বীজ নির্বাচনঃ সাধারনত নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ভালো বীজ নির্বাচনে সহায়ক

রোগমুক্ত, পরিষ্কার, পরিপুষ্ট ও চিটামুক্ত হতে হবে।

সকল বীজের আকার আকৃতি একই ধরনের হবে।

বীজের হারঃ প্রতি শতকে সারিতে বীজের হার  ৮০ গ্রাম এবং  ছিটিয়ে  ১২০ গ্রাম। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬-১০ ইঞ্চি।

বীজ শোধনঃ ভিটাভেক্স ২০০ / টিলথ অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়।

৫. জমি তৈরীঃ

জমি চাষঃ আগে জমি খুব ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে।  জমি ও মাটির অবস্থা বুঝে ৪-৬ টি চাষ দিতে হবে।

৬. বপন ও রোপন এর পদ্ধতিঃ

বপন ও রোপন এর সময়ঃ  বপনের সময় জানুয়ারী-জুন। তবে উচ্চ ফলনশীল জাতের ক্ষেত্রে বীজের প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশিকা অনুসরন করতে হবে।

ছিটিয়ে বা লাইনে বপনঃ ছিটিয়ে বা লাইনে বীজ বপন করা যায়।

৭. সার ব্যবস্থাপনাঃ

সার

এক শতকে

গোবর

৪০ কেজি

ইউরিয়া

৫০০ গ্রাম

টিএসপি

৩০০ গ্রাম

এমওপি

          ৪০০ গ্রাম

সার প্রয়োগের সময়ঃ ইউরিয়া তিন ভাগের এক ভাগ সহ অন্যান্য সব সার বীজ বোনার আগেই মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি দুই ভাগ ইউরিয়া বীজ গজানোর ১০-১৫ দিন পর এবং ২০-২৫ দিন পর দিতে হবে।

৮. আগাছা দমনঃ

সময়ঃ আগাছা হলে নিড়ানীর সাহায্যে তা দমন করতে হবে।

৯. সেচ ব্যবস্থাঃ

সেচের সময়ঃ মাটিতে রস কম থাকলে পরিমিত পরিমাণে সেচ দিতে হবে।

নিষ্কাশনঃ নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।

১০. রোগ ও পোকামাকড় দমনঃ

রোগের নাম

লক্ষণ

প্রতিকার

কীটনাশকের নাম

মরিচা রোগ

এ রোগ গাছের শিকড় ছাড়া সকল অংশকেই আক্রমণ করে। সাদা অথবা হলুদ দাগ পাতার নিচে দেখতে পাওয়া যায়। পরে সেগুলো লালচে বা মরিচা রং ধারন করে এবং পাতা মরে যায়। প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম ডাইথেন এম – ৪৫ ঔষধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ডাইথেন এম – ৪৫

পোকামাকড়ের নাম

লক্ষণ

প্রতিকার

কীটনাশকের নাম

শুয়া পোকা

এ পোকা গাছের পাতা খেয়ে সমুহ ক্ষতি করে থাকে। ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি, রক্সিয়ন ৪০ ইসি, ইকালাক্স ২৫ ইসি ঔষধগুলোর যেকোন একটি ৪.৫ -৫ এম এল প্রতি শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে। ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি, রক্সিয়ন ৪০ ইসি, ইকালাক্স ২৫ ইসি

 

১১. বিশেষ পরিচর্যাঃ নিয়মিত দেখা শোনা করতে হবে।

১২. ফসল কাটাঃ

সময়ঃ বীজ বোনার ৩০ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে শাক খাওয়ার উপযুক্ত হয়। আর ডাঁটার জন্যে আরো বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

১৩. তথ্যের উৎসঃ  AIS, BARI, কৃষি প্রযুক্তি হাত বই, krishitey.com,

১৪. সর্বশেষ সংযোজন : জুলাই,২০১৪

আরো তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন- info@ekrishok.com

কৈ

 

কৈ মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা

কৈ মাছ সাধারণত খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা নালা, প্লাবন ভূমি ইত্যাদিতে চাষ করা যায়। এরা কর্দমাক্তমাটি, গর্ত, গাছের গুঁড়ির তলা ইত্যাদি জায়গায় বাস করতে পছন্দ করে। শিং ও মাগুর মাছের মতোই কৈ মাছ আগাছা, কচুরিপানা, পচা পাতা, ডালপালা বেষ্টিতে জলাশয়ে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিচে পুকুরে কৈ মাছ চাষ করার পদ্ধতি দেয়া হলো-

১. পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতিঃ

  • ছোট বড় সব পুকুরেই চাষ করা যায় তবে পুকুরের আয়তন ২০-২৫ শতাংশ এবং গভীরতা ১.০-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়।
  • পুকুরের পাড় মেরামত, কিছু জলজ আগাছা সংরৰণ ও বার বার জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করতে হবে।
  • প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর শতাংশ প্রতি ৮-১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • কৈ মাছ যাতে পুকুর থেকে উঠে যেতে না পারে সে জন্য বাঁশের তৈরী বেড়া বা নাইলনের নেট দিয়ে পুকুরের চার দিকে বেড়া দিতে হবে। একই সাথে এই বেড়া সাপ, গুঁইসাপ, ব্যাঙ, বেজী প্রতিরোধ করে।

২. পোনা মজুদ,খাদ্য প্রয়োগ ও উৎপাদনঃ

  • প্রাকৃতিক উৎস বা হ্যাচারী থেকে সুস্থ্য ও সবল পোনা সংগ্রহ করে প্রতি শতাংশে ২৫০-৩০০ টি পোনা মজুদ করা যায়।
  • পোনা মজুদের পর মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৬-৮ শতাংশে হারে ৩৫-৪০ শতাংশ আমিষযুক্ত সম্পূরক খাবার দিনে ৩ বার সকাল, দুপুর ও বিকেলে দিতে হবে।

৩. কৈ মাছের রোগ বালাই দমনঃ

রোগের নাম রোগের লক্ষণ চিকিৎসা প্রতিরোধ ব্যবস্থা
শরীরে ক্ষত আক্রান্ত স্থানে তুলার মত সাদা পদার্থ জমা হয়, লেজ ও পাখায় সাদা দাগ সৃষ্টি হয়, লেজ ও পাখায় পচন ধরে ও ক্ষয় ধরে, মাছ দেহের ভারসাম্য হরিয়ে ফেলে। ১. আক্রান্ত মাছ কে ধরে ০.৫ %, ১.০ %, ২.০ % লবণ মিশ্রিত পানিতে ২০-২৫ মিনিট অথবা যতক্ষণ সহ্য করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত গোসল করালে ভালো ফল পাওয়া যায়। ২. মাছের খাদ্যের সাথে প্রতি কেজি খাদ্যের জন্য ৫০-৭০ মিলিগ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অথবা ১০০-১২৫ মিলিগ্রাম সালফার জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে ৭ দিন যাবত মাছকে খাওনো যেতে পারে। ৩. আক্রান্ত ব্রুড মাছের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি দেহের ওজনের জন্য ১০০ মিলিগ্রাম হারে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন প্রদান করা যেতে পারে। ১. মাছ ছাড়ার পূর্বে পুকুর ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে ও পুকুরের তলার অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে। ২. সঠিক ঘনত্নে মাছ মজুদ করতে হবে। ৩. পুকুরে পরিমিত মাত্রায় সার ও খাদ্য প্রদান করতে হবে। ৪. সুস্থ্য সবল পোনা মজুদ করতে হবে। ৫. মজুদের পূর্বে মাছের পোনাকে শতকরা ১ ভাগ লবণ মিশিত পানিতে ২০-২৫ মিনিট গোসল করালে রোগ সংক্রামনের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যায়।
মাছের পরজীবী মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে পরজীবী মাছকে আক্রমণ করে। ২৫-৩০ পি পি এম ফরমালিন পানিতে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা রোগাক্রান্ত মাছকে রেখে পরবর্তীতে পরিষ্কার পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম হারে প্রতি মাসে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পুকুরে গ্যাস দমন পানিতে বুদ বুদ হয়, ও মাছ ভেসে উঠে, গ্যাসের পরিমাণ খুব বেশি হলে মাছ মারা যায়। জিওলাইট গোল্ড (দানাদার/পাউডার) অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

 

কৈ এর ব্রুড ব্যবস্থাপনাঃ

প্রথমে পুকুরের তলা ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুরের তলা যদি শুকানো সম্ভব না হয় তাহলে জাল টেনে বা রটেনন প্রয়োগ করে সমস্ত অবাঞ্ছিত মাছ মেরে এক সপ্তাহ পর প্রতি শতাংশে ১ কেজিহারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। তারপর পুকুর পাড়ের চারপাশ দিয়ে মাটির ১ ফুট গভীর দিয়ে পলিথিন জাতীয় (যা মাটির নীচেও নষ্ট হয় না) জাল দিয়ে ভালভাবে বেড়া দিতে হবে। তারপর পুকুরে পানি দিতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা ৩ থেকে ৪ ফুট এবং অপেক্ষাকৃত কম কাঁদাযুক্ত পুকুর হলে ভাল হয়। পুকুরের দ্রুত বর্ধনশীল সুস্থ ও সবল মাছ প্রজননের জন্য মজুদ করতে হবে। যতদূর সম্ভব বেশি সংখ্যক মাছ থেকে কম সংখ্যক ব্রুড নির্বাচন করাই উত্তম এবং নির্বাচিত মাছকে অবশ্যই ভালভাবে যত্ন করতে হবে। ব্রুড প্রতিপালনের সাধারণত ১৫ থেকে ২০ শতাংশের পুকুর হলে ভাল। প্রতি শতাংশে ১০০ থেকে ১৫০ টি ব্রুড মাছ মজুত করা ভাল। খাবার হিসাবে বাজারের কৈ মাছের যে কোন ব্রান্ডের গ্রোয়ার খাবার খাওয়ালেই চলবে। দেহের ওজনের ৩% খাবারই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি খাবার দিলে কৈ মাছের দেহে বেশি চর্বি হয়ে যেতে পারে। শীতকালে ব্রুড মাছের বিশেষ পরিচর্যা করতে হবে।

প্রজননঃ চাষাবাদের জন্য ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কৈ মাছের প্রজননের জন্য উপযুক্ত সময়। এ ছাড়াও কৈ মাছ যে কেউ ইচ্ছা করলে প্রায় সারা বছরই প্রজনন করাতে পারে। সঠিক পরিচর্যা করলে প্রায় সারা বছরই পেটভর্তি ডিম থাকে যা দেখে স্ত্রী কৈ মাছ সনাক্ত করা যায়। এ ছাড়াও স্ত্রী কৈ মাছ পুরুষ কৈ মাছের তুলনায় অনেক বেশি বড় হয়ে থাকে। পুরুষ কৈ মাছকে সনাক্তের জন্য প্রজনন মৌসুমে পেটে হালকা চাপ দিলেই সাদা রঙের শুক্রাণু বের হয়ে আসে। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে ১টি ইনঞ্জেকশন দিলেই চলে। ইনঞ্জেকশন দিতে হবে পি.জি. দিয়ে। স্ত্রী মাছের জন্য মাত্রা হবে ৬ থেকে ৮ মিঃ গ্রাঃ/কেজি, আর প্রতি কেজি পুরুষ মাছের জন্য পি.জি. দিতে হবে ২ থেকে ৩ মিঃ গ্রাঃ। ইনঞ্জেকশন দিতে হবে মুখের কাছে পাখনার নীচে ফুলার অংশে। পি. জি. দেয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে সমান অনুপাতে অর্থাৎ ১:১ অনুপাতে প্রজনন ট্যাংকে রেখে তারপর পানির স্রোতসহ ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। ইনঞ্জেকশন দেয়ার ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পর মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। ডিম ছাড়ার পর ডিমগুলোকে হ্যাচিং ট্যাংকে নিয়ে যেতে হবে। কৈ মাছের ডিমগুলো ভেসে থাকে। সে জন্য ডিমগুলোকে বিশেষ কায়দায় হ্যাচিং ট্যাংকে নিয়ে যেতে হবে। কৈ মাছের ডিম ভাসমান বিধায় এক বিশেষ পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহের কথা উল্লেখ হচ্ছে যা আমাদের দেশে প্রথম। ডিম সংগ্রহের সময় সর্তকতার অভাবে অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রজনন ট্যাংক থেকে হ্যাচিং ট্যাংক পর্যন্ত ৩ থেকে ৪টি সিরিজ ট্যাংক পাশাপাশি রাখতে হবে। প্রজনন ট্যাংক থেকে প্রতিটি ট্যাংকের বর্হিগমন নালা ২ ইঞ্চি নীচু হতে হবে। তাতে ডিমগুলো আপনা আপনি প্রজনন ট্যাংক থেকে হ্যাচিং ট্যাংকে এসে জমা হবে। নিষিক্ত ডিম এরেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ ও পানি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাপমাত্রা ভেদে ১৮/২০ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। এরপর ২ থেকে ৩ দিন হ্যাচিং ট্যাংকে রাখার পর রেনু পোনাকে সিদ্ধ ডিমের কুসুম ভাল করে ব্লেন্ডার করে তারপর ছেঁকে খাবার হিসাবে দিতে হবে। এভাবে ক’দিন খাওয়ানোর পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।

নার্সারি ব্যবস্থাপনাঃ নার্সারি পুকুরের ব্যবস্থাপনা ২টি ধাপে করা যায়। প্রথমটি হল ১টি পুকুর ব্যবহার করে আর দ্বিতীয়টি হল ২টি পুকুর ব্যবহার করে। ১টি পুকুর ব্যবহার করে পোনা উৎপাদন করলে পোনা ছোট বড় হয়ে যায় এবং চাষের ক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধা হয়। ২টি পুকুর ব্যবহার করলে পোনা তেমন ছোট বড় হয় না। সে জন্য ২টি পুকুর ব্যবহার করাই ভাল। নার্সারি পুকুর আয়তাকার হলে ভাল হয়। এক্ষেত্রে ২য় পদ্ধতির কথা উল্লেখ থাকছে অর্থাৎ ২টি পুকুর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম পুকুরের আয়তন হবে ১০/১৫ শতাংশ এবং ২য় পুকুরের আয়তন হবে ৪০/৫০ শতাংশ। প্রথম পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে শুকাতে হবে। পুকুরের তলা শুকানোর পর পুকুরের পাড়ের চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে শ্যালো মেশিন বা গভীর নলকূপের সাহায্যে ৩ ফুট পরিষ্কার পানি দিতে হবে। পানি দেয়ার পর পরই শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম আটা পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণী প্ল্যাংটন জন্মাবে যা কৈ মাছে রেনুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আটা দেয়ার ২ দিন পর পুকুরে সন্ধ্যায় ০.২ পি.পি.এম হারে সুমিথিয়ন পানির সাথে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এর ২দিন পর রেনু মজুত করতে হবে। ১৫/২০ শতাংশের নার্সারি পুকুরের জন্য ১০০/১৫০ জোড়া কৈ মাছের ব্রুড থেকে উৎপাদিত রেনু পুকুরে ছাড়া উচিৎ। এ পুকুরে ৭/৮ দিন খাওয়ানোর পর রেনুগুলো ধানীপোনাতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন এই ধানীপোনাকে গ্লাস নাইলন কাপড়ের তৈরি হাপা দিয়ে কাটাই করে ২য় পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। এভাবে আরো ১০ দিন খাওয়ানোর পর ধানীপোনাগুলো চারা পোনাতে পরিণত হবে যা পরবর্তীতে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে।

খাবার প্রয়োগঃ রেনু ছাড়ার পর থেকেই পুকুরে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবার হিসেবে ২০ শতাংশের একটি পুকুরে প্রতিবারে ১০টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে ডিমের সাদা অংশসহ ভালভাবে ব্লেন্ডারে মিহি করে গ্লাস নাইলনের কাপড় দিয়ে ছেঁকে পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে দৈনিক ২/৩ বার খাবার প্রয়োগ করতে হবে। ২ দিন খাবার দেয়ার পর ৩য় দিন থেকে ওই পরিমাণ ডিমের সাথে আরো আধাকেজি আটা সিদ্ধ করে ওই ডিমের সাথে মিশিয়ে পুকুরে দিনে ২/৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। আটা প্রয়োগে রেনুমাছ খাওয়ার পাশাপাশি অধিক পরিমাণে প্রাণী প্ল্যাংকটনের জন্ম হবে যা রেনুপোনার জন্য খুবই দরকারী। এভাবে ৫/৬ দিন খাওয়ানোর পর রেনুপোনাগুলো ধানীপোনাতে পরিণত হবে যা পরবর্তীতে কাটাই পুকুরে অর্থাৎ ২য় পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। এই পুকুরে ধানীপোনার খাবার হিসাবে বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি নার্সারি খাবার খাওয়াতে হবে। খাবারে প্রয়োগ পদ্ধতিতে নার্সারি খাবারকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে তারপর পোনাকে খাওয়ানো উচিৎ। খাবারের পরিমাণ হবে প্রতি ৪ লক্ষ মাছের জন্য ১০ কেজি খাবার। এভাবে ৮/১০দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো এক থেকে দেড় ইঞ্চি সাইজের হলে পরবর্তীতে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে।

 

৪. চষী ভাইদের জন্য কিছু গুরুত্তপূর্ণ পরামর্শঃ

  • লাভজনক মাছ চাষে সঠিকভাবে পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
  • প্রতি মাসে একবার প্রতি শতকে ২০০ গ্রাম জিওলাইট ব্যবহার করতে হবে।
  • যে কোন রাক্ষুসে মাছ নিধন করতে হবে।
  • মানসম্মত পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
  • নিয়মিত ফাইটো পালাংটনের ব্লুম হলে খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দিতে হবে।
  • প্রতি ১০/১২ দিন পর পর মাছের গড় ওজন ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষন করতে হবে।
  • মাছকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবের দেয়া যাবেনা।
  • নিয়মিত পানির পি এইচ ও গ্যাস পরীক্ষা করতে হবে।
  • মাছের কোন সমস্যা বা রোগ দেখা দিলে মৎস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

৫. বাজারজাত ব্যবস্থাঃ

বাজার ব্যবস্থাঃ যথাযথ নিয়মে পরিচর্যা করলে ৬ মাসের মধ্যে কৈ মাছ গড়ে ৪০-৫০ গ্রাম হয় এবং প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি উৎপাদন পাওয়া যায়। এবং পার্শবর্তী কোনো হাট-বাজারে বিক্রয় করতে পারেন।

৬. তথ্যের উৎসঃ  AIS, কৈ মাছ চাষ নির্দেশিকা, এস জি এস গ্রুপ

৭. কন্টেন্ট তৈরিঃ ১০/১০/২০১১

৮. সর্বশেষ সংযোজন : জুলাই,২০১৪

আরো তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন- info@ekrishok.com