আদার চাষ পদ্ধতি | ই-কৃষক

আদার চাষ পদ্ধতি

আদা একটি মূল্যবান মশলা জাতীয় ফসল। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে মাত্র ৩৮ হাজার ৫০০ টন আদা উৎপাদন হয়। এ উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তাই চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রচুর আদা আমদানি করতে হয়। উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আদার ফলন এবং উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে আদা রফতানি করা সম্ভব।

পুষ্টিগুণ:
আদায় শতকরা ৮০ ভাগ জলীয় অংশ, ২ ভাগ এলবুমিনয়েড, ১২.৩ ভাগ কার্বোহাইড্রেট, ১.০ ভাগ ফ্যাট, ২৪ ভাগ অাঁশজাতীয় পদার্থ এবং ১.২ ভাগ খনিজ পদার্থ রয়েছে।

ভেষজ গুণ:
আদা জ্বর, ঠা-া লাগা ও ব্যথায় বেশ উপকারী। কুচি আদা চিবিয়ে খেলে গা গোলানো ও বমিভাব থেকে রেহাই পওয়া যায়। অ্যান্টি অঙ্েিডন্টে ভরপুর আদা ক্যানসার ও হার্টের সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। আদা দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। আদার রস খেলে আহারের রুচি আসে এবং ক্ষুধা বাড়ে। আদার রস মধু মিশিয়ে খেলে কাশি দূর হয়। আদার রস পেট ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আদা মল পরিষ্কার করে এবং পাকস্থলী ও লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। আদা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। আদার রস রক্তশূন্যতা দূর করে ও শরীর শীতল রাখে। আদা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কার্যকরভাবে কমাতে সাহায্য করে। আদা রক্তনালির ভেতরের রক্ত জমাটে বাঁধতে বাধা দেয় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

উৎপাদন এলাকা:
নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং যশোর জেলায় প্রচুর আদা উৎপাদন হয়।

আদার জাত:
বাংলাদেশে চাষকৃত আদার জাতের মধ্যে বারি আদা-১ জাতটি ২০০৮ সালে সারা দেশে চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। এটি একটি উচ্চফলনশীল জাত। এর জীবনকাল ২৭০ থেকে ৩০০ দিন। এ জাতের গাছের গড় উচ্চতা ৭৯ থেকে ৮২ সেন্টিমিটার। প্রতি গাছে কুশির সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২টি ও পাতার সংখ্যা ২১০ থেকে ২১২টি। প্রতি গাছে প্রাথমিক কন্দের সংখ্যা ৫৪ থেকে ৫৭টি এবং মাধ্যমিক কন্দের সংখ্যা ৩৯০ থেকে ৩৯৫টি। জাতটি রোগ প্রতিরোধ ও সংরক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন।

জলবায়ু:
আদার জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া দরকার। অল্প ছায়াযুক্ত স্থানে আদা ভালো হয়।

মাটি:
উঁচু বেলে দোঅাঁশ, বেলে ও এঁটেল দোঅাঁশ মাটিতে আদা ভালো জন্মে। আদার জন্য জমিতে পানি নিকাশের সুব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ জমিতে পানি জমে থাকলে আদা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জমি তৈরি:
আদা চাষের জন্য জমি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়। ৬ থেকে ৮ বার চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হয়।

বীজ বোনার সময়:
মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য বৈশাখ হলো স্থানীয় উন্নত জাতের বীজ আদা লাগানোর উপযুক্ত সময়। সেচের সুবিধা থাকলে বৈশাখ মাসে আদা লাগানো যায়। সেচের সুবিধা না থাকলে জ্যৈষ্ঠ মাসে আদা লাগানো উচিত।

বীজ শোধন:
পচন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বীজ আদা শোধন করা উচিত। এজন্য ৮ লিটার পানিতে ১৬ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড বা এক্রোবেট এম জেড মিশিয়ে তাতে ১০ কেজি আদা বীজ ৩০ মিনিট শোধন করে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে নেয়ার পর রোপণ করতে হবে। আদা লাগানের আগে একটি ঝুড়িতে কিছু খড় বিছিয়ে ছোট ছোট আদা তার ওপর বিছিয়ে খড় বা শুকনা পাতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখলে আদার কল বের হবে এবং এ রকম আদা লাগালে তাড়াতাড়ি গাছ বের হবে।

বীজের পরিমাণ:
আদা রোপণের জন্য হেক্টরপ্রতি প্রায় ২.০ থেকে ২.৫ টনের মতো বীজের প্রয়োজন হয়।

রোপণ পদ্ধতি:
ছোট লাঙল বা কোদাল দিয়ে ৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে নালা কেটে তাতে ১৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে ৮ সেন্টিমিটার গভীরতায় দু-তিনটি চোখসহ আদার টুকরা লাগাতে হবে। বীজ আদার ওজন ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম হওয়া উচিত। সারিতে আদা লাগানোর পর সারির ওপর দিয়ে ৫ সেন্টিমিটার পুরু করে খড় বা শুকনা পাতার আচ্ছাদন দিলে তাড়াতাড়ি বীজ থেকে গাছ গজায়। যে অঞ্চলে বেশি বৃষ্টি হয় এবং মাটি এঁটেল অথবা সেচ দিয়ে আদা চাষ করা হয়, সেখানে ওই একই দূরত্বে কোদাল দিয়ে ভেলি তৈরি করে তাতে আদা লাগাতে হবে।

সার প্রয়োগ:
ভালো ফলনের জন্য আদার জমিতে হেক্টরপ্রতি ১০ টন পচা গোবর, ৩০০ থেকে ৩২০ কেজি ইউরিয়া, ২৬০ থেকে ২৮০ কেজি টিএসপি, ২৯০ থেকে ৩১০ কেজি এমওপি, ১০০ থেকে ১২০ কেজি জিপসাম, প্রয়োজনে ১.৮ থেকে ২.২ কেজি বরিক এসিড এবং ৩.৫ থেকে ৪.০ কেজি জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ বপনের ৭ দিন আগে শেষ চাষের সময় জমিতে সম্পূর্ণ গোবর, টিএসটি, জিপসাম, বরিক এসিড, জিংক সালফেট ও অর্ধেক এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ৫০ দিন পর অর্ধেক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমপি সার সমান দুই ভাগে ভাগ করে বপনের ৮০ দিন পর একবার এবং ১১০ দিন পর আর একবার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

রোগ দমন:
আদার জমিতে তেমন কোনো রোগবালাইয়ের উপদ্রব দেখা যায় না। তবে কখনও কন্দ পচা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে।

প্রতিকার:
রোগমুক্ত বীজ আদা রোপণ করা, একই জমিতে বারবার আদা চাষ না করা। জমিতে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা। প্রতি লিটার পানিতে তিন গ্রাম রিডোমিল গোল্ড মিশিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। রোগাক্রান্ত জমিতে ০.৩ শতাংশ রিডোমিল গোল্ড দ্বারা বর্ষার আগে ও পরে আদা গাছের গোড়া ভিজিয়ে দিতে হবে।

পোকা দমন:
আদা গাছে কান্ড ছিদ্রকারী ও পাতাখেকো পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। কা- ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য সেভিন ডাস্ট ২ শতাংশ হারে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করতে হবে। অনেক সময় পাতাখেকো পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এ পোকা দমনের জন্য বিকালবেলা ১ শতাংশ ডেসিস ২ শতাংশ রাইসন স্প্রে করতে হবে।

পরিচর্যাঃ- আদা লাগানোর ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে গাছ বের হয়। দু-তিনবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। গাছ কিছুটা বড় হলে গোড়ায় মাটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।

পানি সেচ:
ভালো ফলনের জন্য আদার জমিতে সেচ দেয়া দরকার। সেজন্য সময়মতো বৃষ্টি না হলে বা খরার সময় ৮ থেকে ১০ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।

আদা তোলা:
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে লাগানো আদা পৌষ মাসে শুকাতে শুরু করলে আদা তুলতে হবে। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে আদা তোলা উচিত। আদা তুলে মাটি পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে।

বীজ আদা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:
নির্বাচিত গাছ সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যাওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন পর বীজ আদা সংগ্রহ করতে হবে। সংরক্ষণের আগে শতকরা ৩ ভাগ ডাইথেন এম-৪৫ দ্বারা বীজ শোধন করলে পচন থেকে আদা রক্ষা করা যায়।

গর্ত খনন করে আদা সংরক্ষণ:
উঁচু জমিতে ৪৫০ সেন্টিমিটার লম্বা, ৩০০ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ১৮০ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত করে শুকিয়ে গর্তের চারপাশ খড় বিছিয়ে থলিতে ভরে একে একে সাজিয়ে মাটির আবরণ দিয়ে ঢেকে আদা সংরক্ষণ করা যায়।

শুকনা বালুতে সংরক্ষণ: এ পদ্ধতিতে শুকনা বালি স্তরের ওপর বীজ আদা ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার পুরু স্তর করে রেখে প্রথমে শুকনা পাতা ও পরে ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার বালির আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। বীজের পরিমাণ বেশি হলে এ পদ্ধতিতে আদা সংরক্ষণ করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখতে হবে।

ফলন: উন্নত পদ্ধতিতে আদার চাষ করে হেক্টরপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টন ফলন পাওয়া সম্ভব।

সূত্র: Modern Agriculture ফেইজবুক পেইজ

Leave a Reply