জারবেরার জাতসমূহ
বারি জারবেরা-১:
এ জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল বহুবর্ষজীবী হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ। গাছ রোমাবৃত (Hairy) এবং ২৫-৩০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। জারবেরা কান্ডহীন, পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং পাতার কিনারা খাঁজযুক্ত। ফুলের রং গাঢ় লাল, কেন্দ্র হালকা সবুজাভ এবং ৯.৫-১০ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জারবেরা সারা বছর চাষ করা যায়, তবে অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়। চারা লাগানোর পর থেকে ১০০-১১০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। প্রতি ঝাড়ে এক বছরে ২০-২৫টির মত ফুল ফোঁটে এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ৯-৯.৫ লক্ষ ফুলের স্টিক। ফুলের সজীবতা থাকে ৮-৯ দিন।
বারি জারবেরা-২:
এ জাতটি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়। পাতার রং হালকা সবুজাভ এবং গভীর খাঁজযুক্ত। গাছ কান্ডহীন, রোমাবৃত এবং ৩০-৩৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলের রং সাদা এবং ৯-৯.৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট। প্রতিটি পুষ্পদন্ডের ওজন ১৪-১৫ গ্রাম। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতটি চাষ করা যায়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর চারা লাগানো যেতে পারে। তবে শীত মৌসুম অর্থ্যাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়। চারা লাগানোর পর থেকে ৮০-৯০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। প্রতি ঝাড়ে এক বছরে ২২-২৫টির মত ফুল জন্মায় এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ৯.৫-১০ লক্ষ ফুলের স্টিক।
মাটি:
জারবেরা চাষের জন্য সুনিষ্কাশিত, ঊর্বর দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি উত্তম। মাটির পিএইচ মাত্রা ৫.৫ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকা উচিত।
বংশ বৃদ্ধি:
জারবেরার বংশ বৃদ্ধি বীজের মাধ্যমে করা যায়। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের সকল গুণাবলী বজায় থাকে না, তবে পদ্ধতিটি সহজ। মাতৃ গাছের ক্লাম্প বিভক্ত করে বংশ বৃদ্ধি করা যায়। এ জন্য মাঠের সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছগুলিকে ছোট ছোট ভাগে ধারালো ছুরি দিয়ে ভাগ করা হয়। উক্ত সকারগুলির (Sucker) পাতা ও শিকড় হালকা প্র“নিং (Pruning) করে পরবর্তীকালে নতুন বেডে (Bed) লাগানো হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে উপরের পদ্ধতি দুটি খুব উপযোগী নয়।
অল্প সময়ে প্রচুর সংখ্যায় রোগমুক্ত চারা পাওয়ার জন্য টিস্যুকালচার পদ্ধতিটি উত্তম। এ জন্য প্রথমে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে। পরে ঐ গাছের কান্ডের বর্ধিত অগ্রাংশ (Growing shoot tips), ফুল কুঁড়ি Flower bud), পাতা (Leaf) ইত্যাদিকে এক্সপ¬ান্ট (Explants) হিসেবে নিয়ে বার বার সাব-কালচার (Sub-Culture) করে অসংখ্য চারা উৎপাদন করা সম্ভব।
জমি তৈরি:
জারবেরার জমিতে পরিমাণমত জৈব সার দিতে হবে। তারপর ৪০-৪৫ সেমি গভীর করে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বিভাবে পরপর কয়েকটি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা (Fine tilth) করে তৈরি করতে হবে।
বেড তৈরি:
এ ফুল চাষের জন্য বেডের উচ্চতা ২০ সেমি এবং প্রশস্ততা ১.০-১.২ মিটার হলে ভাল হয়। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেজন্য দুই বেডের মধ্যবর্তী ৫০ সেমি পানি নিষ্কাশন নালা থাকতে হবে। সাধারণত একবার লাগিয়ে পর্যায়ক্রমে ২ বৎসর ফুল আহরণ করা হয় বলে জমি ও বেড তৈরির সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
চারা লাগানো:
জারবেরার জমিতে বেড তৈরি হলে জাত এবং বৃদ্ধির ধরণ বুঝে সাকারগুলি ৫০ ী ৪০ সেমি দুরুত্ব লাগাতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪০ সেমি। চারাগুলি এমনভাবে রোপণ করতে হবে যেন চারার ক্রাউন মাটির উপরে থাকে। ক্রাউন মাটির নিচে গেলে গোড়া পচাঁ রোগ সংক্রমণের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর চারা লাগানো যেতে পারে তবে শীত মৌসুম, অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাস চারা লাগানোর সর্বোত্তম সময়।
সেচ প্রয়োগ:
এ ফুলের শিকড় গভীরে প্রবেশ করে বিধায় বার বার হালকা ¯িপ্রংকলার সেচের পরিবর্তে প¬াবন সেচ দেয়া উত্তম। পানি সেচের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। কারণ জারবেরা ক্ষেতে জলাবদ্ধতা মাটিবাহিত রোগ সংক্রমণ ত্বরান্বিত করে। আবার মাটিতে পানির অভাব হলে গাছ ঢলে পড়ে, সেক্ষেত্রে ফুলের পুষ্পদন্ড ছোট হয়ে যায়।
সার প্রয়োগ:
জারবেরা দ্রুত বর্ধনশীল একটি ফুল ফসল। গাছের বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ ও গাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিক্রমায় পরিমিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর পর নতুন শিকড় গজানো শুর হলে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। সেজন্য সারের মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
জারবেরাতে সার প্রয়োগের মাত্রা হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ:
সারের নাম |
পরিমাণ/হেক্টর |
সাকার রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে |
সাকার রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে |
রোপণের প্রায় ২০ দিন পরে |
রোপণের ৪৫ দিন পর |
পচা গোবর/কম্পোস্ট |
১০,০০০ কেজি |
সবটুকু |
- |
- |
- |
কোকোডাস্ট |
২,০০০ কেজি |
সবটুকু |
- |
- |
|
ইউরিয়া |
৩৫০ কেজি |
- |
- |
অর্ধেক |
অর্ধেক |
টিএসপি |
২৫০ কেজি |
- |
সবটুকু |
- |
- |
এমওপি |
৩০০ কেজি |
- |
সবটুকু |
- |
- |
জিপসাম |
১৬৫ কেজি |
- |
সবটুকু |
- |
- |
বোরিক এসিড |
১২ কেজি |
- |
সবটুকু |
- |
- |
জিংক অক্সাইড |
৪ কেজি |
- |
সবটুকু |
- |
- |
গোবর/কম্পোস্ট অন্তত ১০-১৫ দিন পূর্বে এবং টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, বোরিক এসিড, জিংক অক্সাইড সাকার রোপণের ৭-১০ দিন পূর্র্বে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপণের প্রায় ২০ দিন পরে ইউরিয়া সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার রোপণের ৪৫ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে একুট দূর দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ প্রদান করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা
রোগবালাই:
বেশ কিছু রোগের আক্রমণ বা প্রাদুর্ভাবের ফলে জারবেরার চাষ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য চারা লাগানোর পূর্বে বেডের মাটি জীবাণুমুক্ত করে নিলে রোগের প্রাদুর্ভাব কম হয়।
মূল পচা:
মাটিবাহিত এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং অবশেষে সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে যায়। মাটি জীবাণুমুক্ত করে চারা লাগালে এ রোগ কম হয়।
গোড়া পচা:
এটিও একটি মাটিবাহিত রোগ। এ রোগের ফলে গাছের কেন্দ্রীয় অংশ প্রথমে কালো রং ধারণ করে ও পরে পচে যায়। পরবর্তীসময়ে পাতা ও ফুল মারা যায়। রিডোমিল অথবা ডায়থেন এম-৪৫ (০.২% বা প্রতি ১ লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম পাউডার) নামক ছত্রাকনাশক দিয়ে গাছের গোড়া ভিজিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায় অথবা টপসিন (০.০৫%) ব্যবহার করেও এ রোগ দমন করা যায়।
পাউডারী মিলভিউ:
দুই ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হতে দেখা যায়। রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি মাত্রায় হলে সমগ্র গাছটির উপরে সাদা পাউডারের আস্তরণ দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। বেনোমিল ৫০ (ডবি¬উ পি) ০.১% বা প্রতি ১ লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে ¯েপ্র করে ভাল ফল পাওয়া যায়।
পোকামাকড়:সাদ মাছি:
সাদা মাছি গাছের বিভিন্ন অংশের রস চুষে মারাতœক ক্ষতি করে। এই মাছির মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণ হয়। চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর থেকে এসাটাফ ৭৫ (এসপি) ও কুমুলাস ডি এফ একসঙ্গে মিশিয়ে ২ গ্রাম করে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ¯েপ্র করতে হবে।
মাইট:
শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় জারবেরাতে মাইটের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এদের আক্রমণে পাতা ও ফুলকুঁড়ির (ঋষড়বিৎ নঁফ) বৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তারপরও যে ফুলগুলি হয়, অস্বাভাবিক আকার ও আকৃতির কারণে এগুলির বাজার মূল্য থাকে না। ভারটিমেক ০.১% ¯েপ্র করে এই মাকড় দমন করা যায়।
ফুল সংগ্রহ:
জারবেরা ফুলের বাহিরের দুসারি ডিস্ক ফ্লোরেট পুষ্পদন্ডের সাথে সমকৌণিক অবস্থানে আসলে ফুল তোলা হয়। কর্তনের সময় পুষ্পদন্ড যথাসম্ভব লম্বা রেখে ফুল সংগ্রহ করা হয়। ধারালো চাকু দ্বারা তেরছা ভাবে কেটে খুব সকালে বা বিকেলে ফুল সংগ্রহ উত্তম। ফুল কাটার পর পুষ্পদন্ড এক ইঞ্চি পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানির সঙ্গে অল্প চিনি এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে দিলে ফুল সতেজ থাকে।
ফলন:
জাতভেদে জারবেরার ফলন কম বেশি হয়। তবে প্রতি ঝাড় থেকে বছরে গড়ে ২০-২৫টি ফুল পাওয়া যায়।
সংকলনে:
কৃষিবিদ মোঃ নূরুল আলম সিদ্দিক
উৎসঃ
কৃষি প্রযুক্তির হাতবই-২০১১, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, গাজীপুর।