পোল্ট্রি পালন
দেশের প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি পুরণ, আছাড়া বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের দারিদ্র বিমোচনে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি পালন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। নিম্নে ব্রয়লার ও লেয়ার পালন ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো-
১. ব্রয়লার মুরগিঃ
ব্রয়লার হলো মাংস উৎপাদনকারী বিশেষ ধরনের মুরগি, যাদেরকে একদিন বয়স থেকে পালন করা হয়, এবং ৩০-৩৫ দিনে এরা মাংস খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়।
ব্রয়লার জাতের নামঃ
হাইব্রো পিএন, হাব্বার্ড ক্লাসিক, কব ৫০০, হাইব্রো পিজি + আরবার একর ও ষ্টারব্রো, ইত্যাদি।
ব্রয়লার মুরগি নির্বাচনঃ
গুণগতমানের ব্রয়লার বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে;
ব্রয়লারের জন্য খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে এমন মুরগির জাত সঠিক ভাবে নির্বাচন করতে হবে। কারণ সব মুরগি সমান ভাবে ওজনে বাড়ে না।
২. লেয়ার মুরগিঃ
লেয়ার মুরগি হলো ডিম উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের মুরগি যাদেরকে একদিন বয়স থেকে পালন করা হয়, যারা ১৮ থেকে ১৯ সপ্তাহ বয়সে ডিম দিতে শুরু করে এবং উৎপাদনকাল ৭২ থেকে ৭৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ডিম উৎপাদনকালীন সময়ে এরা গড়ে প্রায় সোয়া দু’কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি ডিম উৎপাদন করে।
লেয়ার জাতের নামঃ
ডিমের প্রকৃতি বা রং অনুসারে লেয়ার মুরগি দুই ধরনেরঃ
সাদা ডিম উৎপাদনকারীঃ এরা তুলনামূলক ভাবে আকারে ছোট তুলনামূলকভাবে কম খাদ্য খায়, ডিমের খোসার রং সাদা। যেমন: ইসা হোয়াইট, সিভার কার্প, লোহম্যান হোয়াইট, নিকচিক,ব্যবকক-বিভি-৩০০, হাবার্ড হোয়াইট, হাই সেক্স হোয়াইট, শেভার হোয়াইট, হাইলাইন হোয়াইট, বোভান্স হোয়াইট।
বাদামী ডিম উৎপাদনকারীঃ তুলনামূলকভাবে আকারে বড়, খাদ্য বেশি খায়, ডিমের আকার বড়, ডিমের খোসার রং বাদামী। যেমন: ইসা ব্রাউন, হাই সেক্স ব্রাউন, শেভার ৫৭৯, লোহম্যান ব্রাউন, হাই লাইন ব্রাউন, ব্যবকক-বিভি-৩৮০, গোল্ড লাইন, ইসা রোজ, ব্যবলোনা টেট্রা, ব্যবালোনা হারকো, হাবার্ড ব্রাউন।
লেয়ার মুরগি নির্বাচনঃ
লেয়ারের জন্য সঠিকভাবে ভাল উৎপাদনশীল স্ট্রেইন নির্বাচন করতে হবে। কারণ সব মুরগি সমান ডিম দেয় না;
- গুণগতমানের লেয়ার বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে;
- কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের সুনাম রয়েছে এমন বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে;
- সুনাম রয়েছে এমন হ্যাচারী থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
৩. মুরগীর বাসস্থান
মুরগরি ঘরের আবশ্যকতা-
- প্রতিকুল আবহাওয়া, বন্যপ্রাণী ও দুস্কৃতিকারী হতে রক্ষা করতে হবে;
- অনুকুল ও আরামদায়ক পরিবেশ রাখতে হবে;
- বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
- আদর্শ ঘরের গুণাগুণ
- খোলা মেলা থাকতে হবে;
- আলো ও বাতাস চলাচলের সুযোগ থাকতে হবে;
- প্রয়োজনীয় আর্দ্রতাযুক্ত হতে হবে;
- সহজে ঘরের গ্যাস বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে;
- পরিচ্ছন্ন পরিবেশ হতে হবে।
- ঘরের স্থান নির্বাচন
- বন্যার পানি ওঠে না এমন উঁচু ভূমি;
- জনবসতি হতে দূরে;
- হাট-বাজার, কল-কারখানা হতে নিরাপদ দূরে;
- যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল;
- উন্নত বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থা;
- নিকটতম স্থানে বাজারজাতকরণের সুবিধা।
মুরগির ঘরের পরিবেশ
- বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে;
- গ্যাস বের করার সুবিধা রাখতে হবে;
- দূর্গন্ধ মুক্ত রাখতে হবে;
- আর্দ্রতা ও তাপ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা থাকতে হবে।
৪. সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির পদ্ধতি
- তাপ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে;
- টিনের ঘর হলে সিলিং এর ব্যবস্থা রাখতে হবে;
- ঘরের উপর ছায়া তৈরি করতে হবে;
- ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করতে হবে;
- ঠান্ডা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাত্রে চটের পর্দা ব্যবহার করতে হবে;
- লিটার পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. মুরগীর বাসস্থান নির্মাণ প্রস্তুতি এবং ঘরের বৈশিষ্ট্য
মুরগীর ঘরের প্রকৃতি
- উন্মুক্ত বা দো চালা ঘর
- ঘরের অবস্থান: উত্তর-দক্ষিণমুখী;
- ভিতরে: এক দেড় ফুট উঁচু, বেলে দো-আঁশ মাটি;
- মেঝে: পাকা হতে হবে;
আয়তন: মুরগির জাত ও সংখ্যানুযায়ী;
প্রস্থঃ ৩০ ফুটের মধ্যে;
দৈর্ঘ্যঃ প্রয়োজন ও সুবিধানুযায়ী;
দূরত্বঃ একটি হতে অপরটির দূরত্ব ঘরের প্রস্থের কমপক্ষে দেড় গুণ;
উচ্চতাঃ পার্শ্ব উচ্চতা ৭ ফুট, মধ্য উচ্চতা ১২ থেকে ১৪ ফুট (দু’চালা ঘরের);
চালাঃ কাঁচা, পাকা, টিনের। টিনের হলে সিলিং থাকতে হবে। বৃষ্টির ছাট ঝাপ্টা রোধে ঘরের চালা নীচের দিকে বাড়িয়ে দিতে হয়;
বেড়া বা দেয়ালঃ ভিতর হতে উপরে এক ফুট বদ্ধ দেয়াল বা বেড়া, বাকি অংশ শক্ত তারের জাল দ্বারা করতে হবে;
খাঁচা পদ্ধতির ঘর হলে সম্পূর্ণ তারের নেট বা জাল দ্বারা করতে হবে;
ব্রুডার ঘর হলে ভিতরের উপর ৩ থেকে ৪ ফুট আবদ্ধ বেড়া এবং বাকি অংশে তারের নেটের তৈরি;
ঘর তৈরির উপকরণঃ সামর্থ অনুযায়ী ইট, সিমেন্ট, রড, টিন, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি।
৬. খামারে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম ও উপকরণসমূহ
ব্রুডারঃ
বাচ্চা পালন করার জন্য ব্রুডার ব্যবহার করা হয়। ব্রুডারের তিনটি অংশ। যেমন:
ক) হোভার
ব্রুডারের ছাতার মতো অংশকে হোভার বলে। ব্রুডারে যে তাপ সৃষ্টি হয় তাকে বাচ্চার দিকে নিম্নমুখী করার জন্য হোভার ব্যবহার করা হয়। হোভার ৩ থেকে ৮ ফুট ব্যাসযুক্ত হতে পারে।
হোভার তৈরিতে সাধারণত: গ্যালভানাইজড টিন শিটের মাধ্যমে হোভার তৈরি করা হয়।
খ) ব্রুডার গার্ড
হোভারকে কেন্দ্র করে ব্রুডার গার্ড স্থাপন করা হয়। ব্রুডার গার্ড বাচ্চাদের তাপের উৎসের কাছাকাছি রাখতে সাহায্য করে। সাধারণত: হোভারের ২ থেকে ৩ ফুট দূরত্বে হোভারকে বেষ্টন করে ব্রুডার গার্ড দেয়া হয়। ব্রুডার গার্ড তৈরিতে হার্ড বোর্ড, বাঁশের তৈরি চাটাই বা গ্যালভানাইজড আয়রন (জিআই) শিটের সাহায্যে তৈরি করা হয়। এছাড়া তারজালও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তারজাল নিরাপদ হতে হবে যাতে মুরগির বাচ্চা আঘাত না পায়।
ব্রুডার গার্ডের উচ্চতা: সাধারণত: ১৪ থেকে ২০ ইঞ্চি।
গ) ব্রুডার হিটার
বৈদ্যুতিক হিটার
তাপের উৎসঃ ১০০ থেকে ২০০ ওয়াটের ৩ থেকে ৪টি বৈদ্যুতিক বাল্ব হোভারের সাথে যুক্ত করা থাকে। আধুনিক ব্রুডারে বিশেষ ধরনের ফ্যান ব্যবহার করে গরম বাতাস সমান ভাবে বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে তাপমাত্রার প্রয়োজনীয়তা অনুসারে থার্মোমিটারের সাহায্যে পরীক্ষা করে বয়স অনুসারে বাল্বের সংখ্যা কমানো বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া থার্মোস্ট্যাট নিয়ন্ত্রণ যুক্ত বৈদ্যুতিক হিটারও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কেরোসিন হিটার
তাপের উৎসঃ বিশেষ ধরনের বার্ণার বা কেরোসিন স্টোভের উপর হোভার স্থাপন করা হয়।
গ্যাস হিটার
তাপের উৎসঃ গ্যাস বার্ণার হোভারের সাথে সংযুক্ত থাকে অথবা প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে কেন্দ্রিয়ভাবে তাপ উৎপাদন করে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
গরম পানির হিটার
গরম পানি পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করে ঘর গরম রাখা হয়। ঘরের মধ্য বরাবর মেঝের উপর ১২ ইঞ্চি উঁচুতে গরম পানির পাইপ স্থাপন করে তাপ উৎপাদন করা হয়। ঘরের এক প্রান্তে ব্রয়লারে পানি গরম করে লাইনে সরবরাহ করা হয়। গরম পানির পাইপের উপরিভাগে হোভার স্থাপন করা হয়।
ব্রুডারে তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাঃ
হোভার উঁচু-নীচু করে প্রয়োজনীয় তাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৭. ব্রুডিং ঘর
লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে তিন ধরনের ব্রুডিং ঘর ব্যবহার করা হয়
ব্রুডার হাউজঃ এই ঘরে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চা পালন করা হয়।
ব্রুডারড় কাম গ্রোয়ার হাইজঃ এই ঘরে ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চা ব্রুডিং করা হয় এবং ১৫ থেকে ১৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাড়ন্ত বাচ্চা পালন করা হয়।
ব্রুডার-গ্রোয়ার-কাম-লেয়ার হাইজঃ এই ঘরে বাচ্চা ব্রুডিং থেকে শুরু করে ডিম পাড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত (৭৬ থেকে ৮০ সপ্তাহ বয়স) মুরগি পালন করা হয়।
ব্রয়লারের ক্ষেত্রে
বাচ্চা ব্রুডিং ও গ্রোয়িং এর জন্য একই ঘর ব্যবহার করা হয়। ব্রুডার হাউজ বা তাপঘর আলাদা করা যেতে পারে। আলাদা ঘর তৈরি করলে ঘরের বেড়ার নীচের অংশ ৩ থেকে ৪ ফুট বদ্ধ এবং উপরের অংশ খুপরীযুক্ত বা তারের জাল দ্বারা ঘিরে দিতে হয়। ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার জন্য সাধারণত: ০.৫ বর্গফুট মেঝে প্রয়োজন হয়। বাণিজ্যিক খামারে সাধারণত: ব্রুডিং-কাম-গ্রোয়ার ঘর ব্যবহার করা হয়। ব্রুডার-কাম-গ্রোয়ার ঘরে বাচ্চা ব্রুডিং করার জন্য পর্দা দ্বারা ঘিরে ব্রুডার স্থান পৃথক করা হয়। এই ঘরে প্রতি গ্রোয়ার বা বাড়ন্ত মুরগীর জন্য ১ বর্গফুট বা ০.০৯২ বর্গমি. মেঝের প্রয়োজন হয়।
৮. খামারে বাচ্চা আসার পর করণীয়
বাচ্চা ছাড়ার পূর্বে ব্রুডারের তাপ পরীক্ষা করা;
জন্মের প্রথম সপ্তাহে পরিবহনজনিত কারণে বাচ্চা পানি শূন্যতায় ক্লান্ত হয়। তাই এদের জন্য ব্রুডার ঘরে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দ্রুত পানি পান করা শেখাতে হবে। পানির সাথে শতকরা ৫ ভাগ হারে গ্লুকোজ মিশিয়ে দিলে সহজে এরা সেখান থেকে শক্তি পেতে পারে। একইসাথে যে কোন উন্নত মানের মাল্টিভিটামিন ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রস্তুতকারী কোম্পানীর নির্দেশ মতো পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
- বাচ্চার বাক্সে মৃত বাচ্চা থাকলে সরিয়ে ফেলা;
- বাচ্চার সংখ্যা বা গড় ওজন লিখে রাখা;
- যত্নসহকারে ব্রুডার ঘরে বাচ্চা ছাড়া;
- বাচ্চার আচরণ খেয়াল করা;
- বাচ্চার আচরণ অনুযায়ী ব্রুডারের তাপ নিয়ন্ত্রণ করা;
- বাচ্চার পানি পান শেষ হলে ৪ ঘন্টা পর খাদ্য (গম ও ভুট্টাভাঙ্গা, চালের ক্ষুদ) প্রদান করা।
- বাচ্চার আচরণ পরীক্ষা
- বাচ্চা চঞ্চল ও বড় হবে;
- পানি, খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা থাকবে;
- বাচ্চার চোখ উজ্জ্বল হবে;
- নাভি শুকনো হবে এবং দুই পায়ে সমান ভাবে দিয়ে দাঁড়াবে।
- আর্দ্রতা বজায় রাখা
মুরগির ঘরের মেঝেতে যে লিটার বিছানো হয় তার আর্দ্রতা শতকরা ২০ ভাগ থাকা উচিত। লিটারের আর্দ্রতা কমে গেলে মুরগির দেহের জলীয় অংশ শুষে নেয়, ফলে ডিহাইড্রেশন হয়। লিটারের আর্দ্রতা বেশি হলে ঘরে এ্যামোনিয়ার উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং মুরগির শ্বাস-কষ্টজনিত সমস্যা হয়।
পানি প্রদানঃ
প্রাথমিভাবে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা গ্লুকোজ বা চিনি মিশ্রিত পানি প্রদান;
পরবর্তিতে ৩ দিন ভিটামিন মিশ্রিত পানি প্রদান;
ব্রুডারের তাপে পানি গরম হতে দেওয়া (কখনও ঠান্ডা পানি প্রদান করা উচিত নয়)।
খাদ্য প্রদানঃ
- প্রথম দুই দিন বিছানো কাগজের উপর গম বা ভূট্টা ভাঙ্গা বা চালের ক্ষুদ;
- তৃতীয় দিন হতে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সুষম বা সম্পূর্ণ ষ্টার্টার খাদ্য;
- তৃতীয় দিন পাত্রে ষ্টার্টার রেশন দেয়া শুরু;
- চতুর্থ দিন কাগজের উপর খাদ্য দেয়া বন্ধ করতে হবে।
লিটার ব্যবস্থাপনাঃ
- শুকনো মেঝেতে ১ থেকে ২ ইঞ্চি পুরু করে লিটার সামগ্রী বিছানোর পর ব্রুডার গার্ড, হোভার এবং হিটিং সরঞ্জাম বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে;
- খাঁচায় বাচ্চা ব্রুডিং করলে মেঝেতে লিটার বসানোর প্রয়োজন নেই। সরাসরি ব্রুডার খাঁচা স্থাপন করতে হয়;
- ভিজা লিটার তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে নেয়া;
- লিটার জমাট বাঁধতে না দেয়া;
- প্রতিদিন লিটার নাড়া চাড়া করা।
- বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা
- ঘরের দূষিত বাতাস বের হওয়া এবং বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশের জন্য বাতাস চলাচলের প্রয়োজন;
- ছোট ঘরের উপরিভাগে দূষিত বাতাস বের হওয়ার জন্য ফাঁকা জায়গা রাখা হয়;
- বাচ্চার যাতে ঠান্ডা না লাগে সে জন্য সীমিতভাবে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়;
শীতের সময় বিশেষ সতর্কতা করতে হয়। ব্রুডার ঘরের চতুর্পাশে পরিবেশের তাপমাত্রা অনুসারে চট লাগিয়ে দেয়া যেতে পারে। ঘরের ভিতরের তাপমাত্রার উপর এই চট উঠা-নামা করতে হবে। তবে কোন অবস্থাতেই পলিথিন সীট ব্যবহার করা যাবে না।
৯. আলোক ব্যবস্থাপনা
লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রেঃ
লেয়ার বাচ্চার জন্য খোলা ঘরে দিনের আলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রথমে ২৩ ঘন্টা এবং ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পরে ১৮ থেকে ১৯ ঘন্টা এবং পরবর্তী সময়ে ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ থেকে ১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা আলো প্রদান করতে হয়। ডিম পাড়া শুরু হলে আলোক ঘন্টা বাড়িয়ে ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা করা উচিত।
১০. বাড়ন্ত লেয়ার বাচ্চা পালন পদ্ধতি
পুলেট বা বাড়ন্ত বাচ্চা
৪ থেকে ৫ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করা পূর্ব পর্যন্ত বাড়ন্ত বাচ্চা হিসেবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়;
ব্রুডিংয়ের পর খামারে মজুদের জন্য ভাল গুণাগুন সম্পন্ন পুলেট করা হয় যাতে ভবিষ্যতে বেশি ডিম পাওয়া যায়;
ভাল ডিম উৎপাদনের জন্য পুলেট পালন ও নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১১. খামারের জীব নিরাপত্তা
বায়োসিকিউরিটি (জীব নিরাপত্তা)
মোরগ-মুরগিকে রোগ জীবাণুর হাত থেকে নিরাপদে রাখাই হচ্ছে বায়োসিকিউরিটি বা জীব নিরাপত্তার মূল কথা। যে ফার্মের বায়োসিউিরিটি যত ভাল সে ফার্মের সমস্যা তত কম হবে, আর যে ফার্মের বায়োসিকিউরিটি ভাল না সে ফার্মে সব সময় সমস্যা লেগেই থাকবে।
বায়োসিকিউরিটির ক্ষেত্রে প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে-
- বাহির থেকে যাতে কোন জীবাণু শেডে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য খামারকে বহিরাগত মানুষ, কীটপতঙ্গ, বন্য পাখি, গাড়ি, ইদুঁর ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে হবে;
- খামারের প্রবেশ পথে ও শেডের দরজার সম্মুখে সব সময় একটি বড় পাত্রে বা ফুটবাথে জীবাণুনাশক ঔষধের মিশ্রিত পানি রাখতে হবে যাতে খামারের কাজে নিয়োজিত সকলেই শেডে ঢুকার সময় পা ডুবিয়ে জুতা বা স্যান্ডেল জীবাণুমুক্ত করতে পারে;
- শেডের ভিতর জীবাণু, জীবাণুনাশক দিয়ে ধ্বংস করতে হবে;
- খামারে বিভিন্ন বয়সের মুরগি রাখা যাবে না। সব সময় “অল ইন অল আউট” পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। একটি ফার্মে একই বয়সের একই ষ্ট্রেইনের বাচ্চা পালন সবচাইতে ভাল;
- কার্যকরী টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে;
- খামারের সব যন্ত্রপাতি জীবাণুনাশক ঔষধ দিয়ে ধৌতকরণ এবং ফিউমিগেশনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে;
- মৃত মুরগি এবং মুরগির বর্জ্য পদার্থ খামার থেকে দূরে মাটিতে গর্ত করে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পৃথক চূল্লী করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে;
- এক খামারের লোক অন্য খামারে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না;
- খামার পরিচালনায় দক্ষ পরিচালক এবং দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে।
১২. জীবাণুমুক্তকরণঃ
জীবাণুমুক্তকরণের জন্য বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ও ফিউমিগেশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
ক) রাসায়নিক দ্রব্যাদির জন্য ক্লোরিন, আয়োডিন,কষ্টিক সোডা,লাইম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
খ)ফিউমিগেশনের জন্য ১ ভাগ পটাশিয়াম-পার-ম্যঙ্গানেটের সাথে ২ ভাগ ফরমালিন মিশালে ফলমালডিহাইড গ্যাস ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় এবং রোগ-জীবাণু ধ্বংস হয়।
১৩. টিকাদান কর্মসূচি
টিকা প্রদান ও তার গুরুত্বঃ
টিকা প্রদান কর্মসূচি অনুসারে বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করলে-
শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি সৃষ্টি হয় এবং
সংক্রামক রোগ হতে মুরগিকে রক্ষা করা যায়। টিকাদান ফলপ্রসূ হলে রোগের প্রাদুর্ভাব খুব কম হবে এবং মৃত্যুর হার সহনীয় পর্যায় রাখা যাবে।
টিকা প্রদানের পূর্বে সতর্কতাঃ
- মুরগি ধরার সময় যত্ন সহকারে ধরতে হবে;
- মুরগির যে কোন ধরনের ধকল মুক্ত অবস্থায় টিকা প্রয়োগ করতে হবে;
- অসুস্থ মুরগিকে টিকা দেয়া যাবে না;
- টিকা প্রদান উপকরণ ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে;
- আবহাওয়া যখন ঠান্ডা সেসময়ে টিকা প্রদান করতে হবে।
- টিকা ব্যবহারের সাধারণ নিয়মাবলীঃ
- প্রতিষেধক টিকা সবসময়ই সুস্থ পাখিকে প্রয়োগ করতে হয়;
- সংক্রামক রোগ বা কৃমিতে আক্রান্ত পশু-পাখিকে টিকা প্রয়োগ করা যাবে না। তাতে কাঙ্খিত মাত্রায় প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয় না বরং পাখির আরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে;
- টিকা বীজ কোন অবস্থাতেই সূর্যালোকের সংস্পর্শে আনা যাবে না;
- ব্যবহারের সময় মিশ্রণ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে পাত্র, সিরিঞ্জ-নিড্ল, ব্যবহৃত তরল পদার্থ, টিকা ব্যবহারকারীর হাত ইত্যাদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও বীজাণুমুক্ত হওয়া প্রয়োজন;
- জীবাণুমুক্তকরণের জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না;
- প্রতিষেধক টিকা সকালে বা সন্ধ্যার সময় ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রয়োগ করা ভাল;
- ব্যবহারের জন্য গোলানোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা ব্যবহার করে ফেলা উচিত। গোলানোর পর গরমের দিনে ১ ঘন্টা এবং শীতের দিনে ২ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করে ফেলতে হবে;
- মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বা টিকার সাধারণ রং পরিবর্তিত হয়ে গেলে সে টিকা আর ব্যবহার করা যাবে না;
- টিকা পরিবহনের ক্ষেত্রে ঠান্ডা অবস্থায় পরিবহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন;
- তাপ প্রতিরোধক পাত্রের মধ্যে বরফ দিয়ে টিকা বীজ পরিবহন করতে হয়। বরফ গলে গেলে পুনরায় বরফ দিতে হয়;
- ব্যবহারের সময় টিকা মিশ্রণের পাত্র ছায়াযুক্ত স্থানে বরফ দেওয়া বড় পাত্রের মধ্যে রাখা যাবে না;
- ভাইরাস জনিত রোগ প্রতিরোধক টিকা প্রয়োগকালে টিকা প্রয়োগ স্থান পরিষ্কার পানি দ্বারা ধুয়ে নিতে হবে এবং এই জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না;
- গোলানো অব্যবহৃত টিকা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না।
টিকা প্রদান (লেয়ার মুরগির জন্য)
বয়স |
রোগের নাম |
ভ্যাকসিনের নাম |
টিকা প্রদানের পদ্ধতি |
১ দিন |
মারেক্স রোগ |
মারেক্স ভ্যাকসিন |
চামড়ার নীচে ইজেকশন |
২ দিন |
গামবোরো রোগ |
গামবোরো ভ্যাকসিন (লাইভ) |
চোখে ফোঁটা (প্যারেন্ট মুরগির টিকা প্রদান করা না থাকলে) |
৩ থেকে ৫ দিন |
রানীক্ষেত রোগ |
বি, সি, আর, ডি, ভি |
দুই চোখে ফোঁটা (প্যারেন্ট মুরগির টিকা প্রদান করা থাকলে ৭ থেকে ১০ দিন বয়সে) |
৭ দিন |
ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস |
আই, বি, |
চোখে ফোঁটা |
১০ থেকে ১৪ দিন |
গামবোরো রোগ |
গামবোরো ভ্যাকসিন |
এক চোখে ফোঁটা |
২৪ থেকে ২৮ দিন |
গামবোরো রোগ |
গামবোরো ভ্যাকসিন |
এক চোখে ফোঁটা |
২১ থেকে ২৪ দিন |
রানীক্ষেত রোগ |
বি, সি, আর, ডি, ভি |
দুই চোখে ফোঁটা |
৩০ দিন |
ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস |
আই, বি, |
চোখে ফোঁটা |
৩৫ দিন |
মুরগি বসন্ত |
ফাউল পক্স ভ্যাকসিন |
চামড়ার নীচে সুঁই ফুঁটিয়ে |
৫০ দিন |
কৃমি |
কৃমির ঔষধ |
খাদ্য অথবা পানির সাথে |
খাদ্য অথবা পানির সাথে |
খাদ্য অথবা পানির সাথে |
খাদ্য অথবা পানির সাথে |
চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন |
৭০ দিন |
ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস |
আই, বি, |
চোখে ফোঁটা বা পানির সাথে |
৮০ থেকে ৮৫ দিন |
কলেরা |
ফাউল কলেরা ভ্যাকসিন |
চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন |
৯০ থেকে ৯৫ দিন |
ইনফেকসাস করাইজা |
আই, করাইজা ভ্যাকসিন |
চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন |
১১০ থেকে ১১৫ দিন |
কলেরা |
ফাউল কলেরা ভ্যাকসিন |
চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন |
১৩০ থেকে ১৩৫ দিন |
ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস, রানীক্ষেত, |
এগড্রপসিনড্রম |
টিকা চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন |
১৩০ থেকে ১৩৫ দিন |
কৃমি |
কৃমি ঔষধ |
খাদ্য বা পানির সাথে |
৫০ দিন বয়সে কৃমির ঔষধ পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। ১৩০ থেকে ১৩৫ দিন বয়সে ঐ ঔষধ পুনরায় খাওয়াতে হবে।
বি: দ্র: প্রয়োজনবোধে খাদ্যের সাথে ৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ককসিডিওসিস রোগ প্রতিরোধের জন্য ককসিডিওস্ট্যাট ব্যবহার করতে হবে। এই তালিকা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রোগের প্রার্দুভাবের ইতিহাস, টিকার প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নিজ নিজ খামারের জন্য নিজস্ব তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। টিকা সবসময় প্রস্তুতকারীর নির্দেশমত ব্যবহার করতে হবে।
কয়েকটি ভ্যাকসিন বাজারজাতকারী কোম্পানীর তালিকাঃ
- এ্যাডভান্স এনিমেল সায়েন্স কোং লিঃ
- এসিআই লিঃ
- বেঙ্গল ওভারসীজ লিঃ
- এফএনএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ
- জেসন এগ্রোভেট লিঃ
- ফার্মা এন্ড ফার্ম
- ইউনিভেট লিঃ
- নোভারটিস
বি: দ্র: সকল প্রকার টিকা ও ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞের বা ই-কৃষকের পরামর্শ নিতে হবে।
১৪. ব্রয়লার বাজারজাতকরণ
ব্রয়লার বাজারজাতকরণের সময় লক্ষ্যনীয় বিষয়
ব্রয়লার উৎপাদনের সাথে সাথে বাজারজাত করতে না পারলে খামারের ক্ষতি হয়। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত একদিনের জন্যও খামারে মুরগি থাকার অর্থ ঐ দিনের অতিরিক্ত খাদ্য ও শ্রম খরচ এবং পরবর্তী কর্মসূচীতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়;
এক ব্যাচে সমস্ত ব্রয়লার একইসাথে বিক্রি করতে হয়। পুরুষ ব্রয়লারের ওজন বৃদ্ধি শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেশি হয় এবং এক সপ্তাহ পূর্বে নির্দিষ্ট ওজনের হয়;
১৫. তথ্যের উৎসঃ AIS (http://ais.gov.bd/)
১৬. কন্টেন্ট তৈরিঃ ২৪/১০/২০১১
১৭. সর্বশেষ সংযোজন : জুলাই,২০১৪
আরো তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন- info@ekrishok.com