সবুজ সারের সারাংশ | ই-কৃষক

সবুজ সারের সারাংশ

সবুজ সারের আদ্যোপান্ত

সবুজ সার কি?
কোন উদ্ভিদকে সবুজ অবস্থায় চাষ দিয়ে মাটির সাথে মেশানোর ফলে পঁচে যে সার উৎপন্ন হয় তাকে সবুজ সার বলে এবং এ পদ্ধতিকে সবুজ সারকরণ বলে। অন্য কথায়, মাটির জৈব পদার্থের ক্ষয়পূরণ বা উহা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে কোন ফসল জন্মিয়ে একই স্থানে সবুজ গাছ গুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়াকে সবুজ সার বলে। জমিতে সবুজ সার ব্যবহার করা আজকের নতুন কোন বিষয় নয় বরং স্মরণাতীতকাল থেকেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য এর চর্চা চলে আসছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে রোমানগণ সর্বপ্রথম সীম জাতীয় শস্য সবুজ সার হিসেবে ব্যবহার করে। খ্রিস্টীয় যুগের আগ থেকেই রোমান বা চীনারা সবুজ সার তৈরী করতো। প্রায় দু’হাজার বছর আগে মটর, মসুর এ কাজে ব্যবহার করা হতো (মার্টিন ইট অ্যাল, ১৯৬৭)।

সবুজ সার জাতীয় গাছের পরিচিতি:
শুঁটি (শিম্বি) জাতীয় ও অশুঁটি (অশিম্বি) জাতীয় উভয় প্রকার ফসল দ্বারাই সবুজ সার করা যায়। প্রায় ৩০ টির মত শুঁটি জাতীয় এবং ১০ টির মত অশুঁটি জাতীয় শস্য রয়েছে। তবে আমাদের দেশে সচরাচর শুঁটি জাতীয় গাছই সবুজ সার হিসেবে চাষ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ধৈঞ্চা, শন, বরবটি, প্রভৃতি প্রধান। এছাড়া সীম, খেসারী, মুগ, মাসকলাই, সয়াবিন, মসুর, ছোলা, মটর, চীনাবাদাম, অড়হর ঝাড়সীম, প্রভৃতিও শুঁটি জাতীয় শস্য। অশুঁটি জাতীয় গাছের মধ্যে মধ্যে ভুট্রা, জোয়ার, আখ, এসব রয়েছে। তবে এগুলো দিয়ে সাধারণত সবুজ সার তৈরি করা হয় না।

সবুজ সার জাতীয় গাছের গুণাবলি:
সবুজ সার জাতীয় গাছের সেগুলো তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন -
১. গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হতে হবে যাতে অল্প সময়ের মধ্যে সবুজ সার করা যেতে পারে।

২. গাছের পাতা, কান্ড ও অন্যান্য অংশ অধিক নরম ও রসালো হতে হবে।

৩. অনুর্বর মাটিতে ও গাছের শাখপ্রশাখা উৎপাদনের গুণ থাকতে হবে।

১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী বাকম্যান ও ব্রাডী উপযুক্ত তিনটি গুণের আবশ্যকতার কথা পুনরোল্লেখ করেছেন।

এ তিনটি মৌলিক গুণ ছাড়াও সবুজ সার ফসলের আরো বেশ কিছু গুণ থাকা আরও ভাল। যেমন:

১. সবুজ সার জাতীয় গাছের শিকড়ে গুঁটি বা অর্বুদ তৈরির স্বভাবধর্মী হওয়া একটি বিশেষ গুণ। মাটির অভ্যন্তরে রাইজোবিয়াম নামক এক প্রকার জীবাণু যাহা শূঁটি জাতীয় গাছের শিকড়ে বাসা বাধেঁ ও বায়ুম-লের নাইট্রোজেনের সাহায্যে গুটি তৈরি করে। পরে শুঁটি জাতীয় গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিলে নাইট্রোজেন সার ও জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে।

২. সবুজ সার জাতীয় গাছ স্বল্প মেয়াদী এবং প্রচুর বীজ উৎপাদনক্ষম হওয়া উচিত।

৩. চাষাবাদ পদ্ধতি সহজতর হতে হবে। এসব ফসলে চাষের খরচ কম ও পরিচর্যার তেমন দরকার না হওয়াও আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

৪. গাছ খরা সহনশীল হলে ভাল হয়।

৫. গাছ দ্রুত বেড়ে উঠে প্রথম থেকেই আগাছা দমনের ক্ষমতা থাকতে হয়।

৬. রোগবালাই ও পোকামাকড়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে।

৭. অম্ল, ক্ষার বা লবণাক্ত মাটিতেও জন্মাবার যোগ্য হতে হবে।

৮. ইহা গভীর শিকড় বিশিষ্ট হওয়া উচিত।

সবুজ সারের উপকারিতা:
১. আমাদের মাটিতে জৈর পদার্থের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। সবুজ সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণও বাড়ে ফলে অনুর্বর মাটি অপেক্ষাকৃত উর্বর হয়।

২. সবুজ পদার্থ মাটিতে মিশিয়ে দিলে নাইট্রোজেন ছাড়াও জৈব পদার্থের সংগে ফসফেট, চুন,ম্যাগনেসিয়াম সবগুলো প্রধান খাদ্য উপাদান ও অনু খাদ্য উপাদানগুলোও সরবরাহ করে, যা গাছের জন্য প্রয়োজনীয়।

৩. মাটির গঠন ও গুণাগুণ উন্নত করে। এতে বেলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে ও মাটির অভ্যন্তরে বাতাস চলাচলেও সুবিধে হয়।

৪. সবুজ গাছ পচার সময় জীবাণুর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় ও গাছের খাদ্যবেশি করে সহজলভ্য হয়।

৫. মাটির নীচে থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবং মাটিতে মিশিয়ে দেবার পর মাটির উপরের স্তরে থেকে যায় ও পরবর্তী ফসল সহজেই গ্রহণ করতে পারে।

৬. চোঁয়ানির ফলে খাদ্য উপদানের অপচয় এর দ্বারা কমে যায়।

৭. সবুজ সার প্রয়েগের ফলে ফসলের অন্যতম শত্রু আগাছার উপদ্রব কম হয়।

৮. কোন কোন সবুজ সার জাতীয় গাছ মাটিতে আচ্ছাদন সৃষ্টি করে রাখে ও ভূমিক্ষয় রোধ হয়।

৯. সবুজ সার জমির আর্দ্রতা ও জোঁ বজায় রাখতে সাহায্য করে।

১০. শস্যের চারা গাছের সাথে জন্মানো হলে গরমকালে প্রখর রোদ তাপ হতে ঐ ফসলকে ছায়া দিয়ে রক্ষা করে।

সবুজ সার ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা:
১. সবুজ সারের চাষ করাকালীন একটি স্বল্প মেয়াদী ফসল জন্মানো যায়। তাই সবুজ সার চাষ করতে যে ক্ষতি হয় পরবর্তী ফসল দিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

২. সবুজ সার পচবার জন্য বৃষ্টির পানির দরকার অথবা সেচের ব্যবস্থা থাকা দরকার।

৩. কোন কোন এলাকায় বীজের অভাব দেখা দেয়।

সবুজ সার প্রস্তুত প্রণালী:
কয়েকটি আদর্শ সবুজ সার জাতীয় ফসলের চাষ ও সবুজ সার প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

ধৈঞ্চা:
নাইট্রোজেন উৎপাদনকারী সবুজ সার জাতীয় গাছ বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ও মাটিতে ভাল জন্মে। সারা বছরই ধৈঞ্চার চাষ করা যায়, তবে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। দু’একটি চাষ ও মই দিয়ে ধৈঞ্চার বীজ ঘন করে বুনতে হয়। কোন সার ছাড়াই প্রতিকূল আবহাওয়ায় ও যে কোন ধরনের মাটিতে ভাল জন্মে। তবে শিকড়ে শুঁটির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য হেক্টর প্রতি ১৭.০ কেজি টিএসপি ব্যবহার করা দরকার। প্রতি হেক্টরে ৪০/৫০ কেজি বীজ ঘন করে ছিটিয়ে বুনতে হয়। কোন যত্ন বা নিড়ানি ছাড়াই গাছ দ্রুত বড় হয়ে উঠে। বীজ বপনের ৬-৮ সপ্তাহ পরে গাছগুলো ১-১.৫ মিটার উঁচু হলে বা ফুল ফুটলে সবুজ সার তৈরীর উপযুক্ত সময়।
প্রথমে মই বা তক্তা দিয়ে ধৈঞ্চা গাছ মাটিতে শুইয়ে দিতে হয়। গাছ বেশি লম্বা হলে কাঁচি দিয়ে ২ থেকে ৩ টুকরো করে নিলে চাষ দিতে সুবিধে হয়।
ধৈঞ্চা গাছ শোয়ানোর পর একই দিক থেকে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশাতে হবে। সে সময় ক্ষেতে পানি থাকলে মাটির সাথে সহজে মিশে যায়।
ক্ষেতে পানি জমা করে রাখলে গাছ দ্রুত পচে।
প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন পর পুনঃ চাষ বা মই দিলে তাড়াতাড়ি পচে যায়। ধৈঞ্চা গাছ পচতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগতে পারে। সবুজ সারের চাষ করার পর রোপা আমন ধান ভাল জন্মে।

ধৈঞ্চা সার:
এক হেক্টরে প্রায় ৮ টন কাঁচা সবুজ পদার্থ এবং আনুমানিক ৪০ কেজি নাইট্রোজেন পাওয়া যায় (টেমহেন ইট অ্যাল, ১৯৭০)। গাছের বয়স ৩-৫ মাস হলে ১০-১৫ টন জৈব পদার্থ এবং প্রায় ৮০ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন পাওয়া যেতে পারে। এতে শতকরা ০.৬২ ভাগ বা এর কিছু কম বেশি নাইট্রোজেন থাকতে পারে।

শন:
এটি একটি উৎকৃষ্ট সবুজ সার জাতীয় গাছ। ধৈঞ্চার অনুরূপ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি প্রায় ৪০-৫০ কেজি বীজ ঘন করে বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসে বুনতে হয়। উঁচু জমিতে এবং দো-আঁশ মাটিতে এটি ভাল জন্মে। তবে অনাবৃষ্টি ও দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। ক্ষেতে নালা রাখা দরকার। গাছ ১.২-১.৫ মিটার উঁচু হলে ৭ থেকে ৮ সপ্তাহ পর বা ফুল দেখা দিলেই ধৈঞ্চার মত মাটিতে মিশিয়ে দেয়া উচিত।
শন পচবার জন্য জমিতে পানি রাখা ভাল এবং মাটিতে মেশানোর প্রায় ১৫ দিন পর চাষ ও মই দিয়ে দিলে দ্রুত পচে। গাছ পচতে মাস খানেক সময় লাগে।

শন সার:
গাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী প্রতি হেক্টরে প্রায় ৮ টন (১০-১৫ টনও হতে পারে) কাঁচা সবুজ পদার্থ এবং ৪০ কেজি কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ নাইট্রোজেন পাওয়া যেতে পারে এবং উহার বেশির ভাগ আসে বায়ু মন্ডল থেকে। শন গাছের পাতায় শতকরা ০.৭৫ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১২ ভাগ ফসফরাস ও ০.৫১ ভাগ পটাসিয়াম থাকে।

বরবটি:
বরবটি সবুজ সার হিসেবে চাষ করা যায় যদিও মানুষ ও পশু খাদ্যরুপেও এর চাষ হয়। ক্স বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাসে হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ কেজি বীজ বনতে হয়। সাধারণত উঁচু জমিতে এগুলো জন্মানো হয় কারণ পানি দাঁড়ালে ভাল হয় না। লাল মাটিতে সবুজ সার হিসেবে এটি খুবই উপযুক্ত। এটি বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ে এবং মাত্র ছয় সপ্তাহে ফুল ফুটে এবং সবুজ সার প্রস্তুতের উপযুক্ত হয়। ঐ সময় চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।

বরবটি সার:
প্রতি হেক্টরে ৬-১০ টন সবুজ পদার্থ মাটিতে যুক্ত হয়। এতে শতকরা ০.৭১ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১৫ ভাগ ফসফরাস ও ০.৫৮ ভাগ পটাসিয়াম থাকে।
ইপিল ইপিল: এ গাছের শিকড় বছরে প্রতি হেক্টরে জমিতে ৫৫৬ কেজি নাইট্রোজেন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারে। অনুরূপভাবে কলাই, মুগ, অড়হড়, সীম, খেসারী, সয়াবিন প্রভৃতি সবুজ সারের জন্য খুবই উপযুক্ত।

অধিকারী চ. মিঠু's photo.
সূত্র: Modern Agriculture Facebook Page

Leave a Reply